|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
‘এখন রসটা ধরতে পারলে হয়’ |
ভাষা তো নয়, যেন জাদুকরের হাতের ছড়ি, যার ছোঁয়া লাগলে পুতুলও প্রাণ পায়, আর যে-কোনও জড় বস্তুত যেন নিমেষে স্বতশ্চল হয়ে ওঠে।— লীলা মজুমদারের গদ্য নিয়ে আলোচনায় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। বেরিয়েছে তাঁর পত্রমালা (লালমাটি, ১৫০.০০), আর তা নিয়েই ভূমিকা-য় নীরেন্দ্রনাথ লিখছেন ‘তাঁর ভাষার সেই জাদুদণ্ডের ছোঁয়া, কাজের কথায় ভর্তি চিঠিকেও যা অতি অনায়াসে সাহিত্যের পর্যায়ে তুলে আনে।’ কথাটা কতটা সত্যি তা টের পাওয়া যায় তাঁর জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষজনকে লেখা চিঠিপত্র থেকে। যেমন রেবন্ত গোস্বামীকে লেখা একটি চিঠি থেকে চেনা যায় সমালোচনা সম্পর্কে লীলা মজুমদারের মনটা: ‘স্পষ্ট কিন্তু ভদ্র ভাষায় ও উদার চিত্তে আলোচ্য বিষয়ের ভালোমন্দ দিক তুলে ধরাই হল সমালোচনার মূল উদ্দেশ্য। কোনো ব্যক্তিগত ভাবের যেন উৎপাত না ঘটে। আমি অবশ্যই তোমার পর্যালোচনা পড়ে দেখব। অন্যায় দেখলেই বলব। শুধু মতের অমিল হলে কিছু বলব না।’ আবার অজেয় রায়কে লেখা একটি চিঠিতে উঠে আসে লেখালেখির গুরুত্ব বা দায়িত্বের কথা: ‘আমাদের তো দিন ফুরিয়ে এল। তবু একবারও মনে হয় না বৃথা সময় নষ্ট করেছি। জিনিসপত্রের কাজ ফুরোয় কিন্তু চিন্তার কাজ কখনো ফুরোয় না। লিখে যাবি।’ ‘সন্দেশ’ পত্রিকার সঙ্গে ওতপ্রোত কাউকে-কাউকেও চিঠি লিখেছেন, যেমন ‘স্নেহের শিবানী’কে লিখছেন ‘খুশি হবে শুনে যে “পদীপিসির বর্মি বাক্স’’ film হচ্ছে। অরুন্ধতী আর তপন সিংহ করছে। এখন রসটা ধরতে পারলে হয়।’
লীলা মজুমদারকে নিয়ে মৌসুমী চক্রবর্তীর বইটির নাম যথার্থ: লীলা মজুমদার: সৃষ্টির বহুবর্ণ (বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, ১৫০.০০)। রায়-পরিবারের এই প্রতিভাময়ী সাহিত্যের নানা শাখাতেই তো তাঁর দ্যুতিময় স্পর্শ রেখে গিয়েছেন, তাঁর সেই বহুবর্ণময় ব্যক্তিত্বকেই মূল্যায়নের চেষ্টা এ বইয়ে। পূর্বভাষ-এ উজ্জ্বলকুমার মজুমদার জানাচ্ছেন ‘মৌসুমীর এই আলোচনা অসাধারণ গদ্যশিল্পী লীলা মজুমদারের সম্পর্কে প্রথম সামগ্রিক মূল্যায়নের চেষ্টা।’
মৌ চক্রবর্তীর সোনা নয় রূপা নয়/ জ্যোতির্ময়ী দেবী: সৃষ্টি ও মূল্যায়ন-এ (বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, ২০০.০০) সাহিত্যিক জ্যোতির্ময়ীকে নিয়ে আলোচনা। নিবেদন-এ মৌ জানাচ্ছেন ‘জ্যোতির্ময়ী দেবীর সাহিত্যের বিষয়, পটভূমি, চরিত্রায়ণ এবং সমস্যাগ্রন্থির স্বরূপের পরিচয় নিলে বোঝা যায়, ভারতবর্ষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা সম্পর্কে তিনি যথেষ্টই অবহিত ছিলেন।... একরকম আধুনিক মননের অধিকারী ছিলেন তিনি। নারী সাহিত্যিকরা শুধু অন্দরমহলের আখ্যানই রচনা করেন না, তাঁদের থাকতে পারে চৌকাঠের ওপারের একটা বৃহত্তর দেশ ও সময়ের খোঁজ— জ্যোতির্ময়ী দেবীর গল্প, উপন্যাস, গদ্য, কবিতা ইত্যাদি সৃষ্টিকর্মের মূল্যায়নের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তেই শেষপর্যন্ত উপনীত হয়েছি আমরা।’ তাঁকে নিয়ে সামগ্রিক আলোচনার পর রয়েছে পরিশিষ্ট, তাতে তাঁর চিঠিপত্রের প্রতিলিপি, জীবনপঞ্জি, তাঁকে ও তাঁর সৃষ্টি নিয়ে বিশিষ্ট জনের আলোচনা, নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি, এবং তাঁর নিজের অগ্রন্থিত রচনা।
অনার কিলিং, নারীর প্রতি হিংসা, বিশ্বায়নের জোয়ারে ভারতীয় নারীর হাল, নারীর কবিতা— বিবিধ নারীকেন্দ্রিক বিষয়ে ন’টি প্রবন্ধের সংকলন কিঙ্কি চট্টোপাধ্যায়ের অনারকিলিং ও অন্যান্য: মেয়েদের যাপনচিত্র (সপ্তর্ষি প্রকাশন, ১৫০.০০)। মুখতার মাঈ থেকে মালালা, বিভিন্ন রঙিন ছবি বইটির গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে।
মেয়েলি আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা থেকেই সুতপা ভট্টাচার্যের মেয়েলি সংলাপ-এর প্রকাশ (কারিগর, ৩০০.০০)। শুরুর কথা-য় জানিয়েছেন সুতপা: “সখী-সংলাপ’ নামে একটি সভা কল্পনা করে নিয়েছি এই বইতে। নিজেরই লেখা বসিয়েছি নানান কাল্পনিক চরিত্রের মুখে, আবার সেসব লেখার সমালোচনাও করেছি নিজে, অন্যের জবানিতে।’’ আর বইটির অধ্যায়গুলি গ্রথিত হয়েছে ওই সভাটির প্রধান উদ্যোক্তা ঋতদীপার ডায়েরির লেখা দিয়ে। সে ডায়েরির একটি অংশ তুলে আনলেই সুতপার স্বাধীন স্বরের খানিকটা আন্দাজ পাওয়া যাবে: ‘প্রাকৃতিকতার বিরুদ্ধতা করেই তো মানুষের সমাজ গড়া। ভিন্নলিঙ্গের যৌনতাটা যে নিয়ম, সেটা সেই সমাজেরই নির্দেশে। মানুষের স্বাধীনতাকে যদি মান দিই, তবে তো তার নির্বাচনের সুযোগ থাকাই উচিত— সমলিঙ্গ অথবা ভিন্নলিঙ্গ, দুধরনের যৌনতার মধ্যে। মানুষ তার অন্তরঙ্গ সঙ্গী বাছবে, সে তো নিজের অভিরুচি অনুসারে বাছাই ভালো। আমাদের অধিকাংশেরই সমলিঙ্গে কোনো অভিরুচি নেই, নাই থাকল। তাই বলে যদি কারো অভিরুচি থাকে, তাকে মন্দ বলতে যাব কেন?’ |
|
|
|
|
|