পুস্তক পরিচয় ১...
যৌনতারও প্রাদেশিকতা আছে
রমণী, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী। কারিগর, ৪৫০.০০
চোদ্দোটি পরস্পর সম্পর্কিত নিবন্ধের সংকলন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর রমণী। সংস্কৃত ভাষায় লেখা মহাকাব্য, পুরাণ থেকে শুরু করে কান্তকোমলপদাবলি আশ্রিত, বৃন্দাবনের বৈষ্ণবতত্ত্ব অধিকৃত রাধা-কৃষ্ণ কথা পর্যন্ত নানা উদাহরণ বেছে নৃসিংহপ্রসাদ তাঁর ‘ভারতীয়’ রমণী সম্বন্ধীয় চিন্তা ও যুক্তির বয়ান সাজিয়েছেন। এসেছে শাস্ত্র ও সংহিতার প্রসঙ্গও। দীর্ঘ সময়কাল তাঁর আলোচনার বিষয়। তবে ধারাবাহিক ভাবে সেই আলোচনা করেননি। তা উদ্দেশ্যও নয়। টুকরো টুকরো করে নানা কথা পরিবেশন করেছেন। বিশেষ তাত্ত্বিক কাঠামো অনুসরণ করেছেন এমন বলা যাবে না।
ভারতীয় রমণী বিষয়টি এমনিতে খুবই গোলমেলে। ভারতীয় রমণীর বৈশিষ্ট্য তো কোনও এক-দুই মাত্রার মধ্যে ধরা পড়ার নয়। কেমনটি এই প্রাচীন রমণীরা তা নিয়ে নানা জনের নানা কল্পনা, বিশেষ উদ্দেশ্য থেকে সেই সব কল্পনার নির্মাণ ঘটানো হয়েছিল। সূত্রপাত সেই উনিশ শতকেই। কল্পনার বিবিধ ঘরানা— দেশিদের পাশাপাশি বিদেশিরাও এই প্রাচীনের নির্মাণে সিদ্ধহস্ত। উনিশ শতকীয় সেই নির্মাণকে প্রশ্ন করাও হয়েছে অনেক দিন, প্রশ্ন করেছেন অনেকেই। সুকুমারী ভট্টাচার্যের রচনার তথ্য ও যুক্তি প্রাচীন ভারতের সমাজের নানা টানাপড়েনকে তুলে ধরেছে— রোম্যান্টিক কল্পনার সুদূর মোহময় জাল ছিন্ন হয়েছে। সুবর্ণ অতীতের কল্পনাকারী ভারতীয়রা প্রাচীন ভারতকে যে ভাবে সব ভালর দেশ হিসেবে দেখাতে চাইতেন— নারীদের নানা অধিকার ছিল দাবি করতেন— বিষয়টি যে তেমন নয় তা মোটের ওপর এখন মেনে নেওয়া হয়েছে।
প্রাচীন ভারতের মেয়েদের কথা উঠলেই সতীত্ব, শৃঙ্গার ইত্যাদির প্রসঙ্গ সামনে আসে। এই বইটির নাম রমণী, মেয়ে বা নারীর থেকে রমণীমূর্তি আলাদা। রমণী শব্দের মূলে রমণ শব্দটি রয়েছে— eroticism, sexuality এই লেখাগুলির বিষয়। বিবাহ, বেদপাঠের অধিকার, মেয়েদের প্রতিবাদ নিয়ে নিবন্ধ রয়েছে। সাহিত্য ও শাস্ত্র থেকে নানা প্রসঙ্গ আলোচিত, তত্ত্ব ও তথ্যের প্রয়োজনমাফিক অবতারণা করা হয়েছে, তবে তা লঘু চালে। আলোচনায় উনিশ শতকীয় জাতীয়তাবাদীরা ও সাম্প্রতিক কালের স্বাদেশিকতাবোধ বর্জিত পাশ্চাত্য তত্ত্বনিষ্ঠ দেশজরা ও ভারতবিষয়ক লেখা শানানো সাহেবরা শ্রীভাদুড়ীর পূর্বপক্ষ। তাঁদের সঙ্গেই নাম করে না করে তাঁর ‘উতোর’, কোথাও কোথাও ‘চাপান’ দিতেও ছাড়েননি। উনিশ শতকের হিন্দু পুনরুত্থানবাদীরা প্রাচীন ভারতীয় রমণীদের সতীত্বের বিষয় নিয়ে গভীর ভাবে উত্তেজিত। প্রাচীন ভারতের সতীত্বের আদর্শ অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় বলে তাঁরা মনে করতেন— সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী ভারতীয় নারীজাতির আদর্শ ছিলেন ও হবেন এই ছিল তাঁদের একদলের অভিমত। প্রাচীন ভারতের রমণী বলতেই অবশ্য সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তীকে বোঝায় না। নৃসিংহপ্রসাদের এই বইতেই আছে তারার কথা। বালির স্ত্রী তারা বালি-সুগ্রীব-বালি-সুগ্রীব ক্রমে জীবন যাপন করেছেন। বালি “রামের হাতে মারা গেলে তারা দণ্ড দু-চার কান্নাকাটি করলেন, তারপরই বালির অন্তিম কৃত্যের পর সুখশায়িত হলেন সুগ্রীবের শয্যায়” (পৃ.৩২)
সুতরাং প্রাচীন ভারত কেবল একগামী রমণীদের গর্ভভূমি ছিল না। আবার ‘ভারত-পুরুষ’ কৃষ্ণের রমণী উপভোগের বিষয়টিকে জাতীয়তাবাদী আবেগ থেকে অনেকেই উনিশ শতকে প্রক্ষিপ্ত হিসেবে বাদ দিতে চাইতেন। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর কৃষ্ণচরিত্র বইতে জনসমাজে প্রচলিত কৃষ্ণবিষয়ক ‘পাপোপাখ্যান’কে নিতান্ত বানানো উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। গোপনারীর পাতিব্রত্যধর্ম কৃষ্ণ নষ্ট করেছেন বঙ্কিম তা বিশ্বাসই করেন না। ভাগবতীয় উপন্যাসের ঘোর বিরোধী বলে রমণী ও শিশুপাঠ্য বাংলা ভাষায় বস্ত্রহরণের অমন রসালো বিবরণ পর্যন্ত অনুবাদ করতে তিনি নারাজ। বঙ্কিমের কৃষ্ণচরিত্র নির্মাণের পেছনে তর্ক-যুক্তির অসামান্যতা ছিল তা মানলেও নৃসিংহপ্রসাদ বঙ্কিমের মতের বিরোধী। আবার “পশ্চিমের পান্তা-খাওয়া গবেষককুল নিজের থিসিস জমানোর জন্য... এক, দুই, তিন, কি চার কিসিমের কৃষ্ণের আমদানি” করতে চেয়েছেন— সে কথাও তিনি মানেন না, “সম্পূর্ণ দেশীয় পদ্ধতিতে গবেষকের মতোই চার কিসিমের কৃষ্ণকে” তিনি মেলাতে পারেন। (পৃ. ৫৩) বোঝা যায় ভারতীয় রমণীয়দের জীবনবৃত্তান্ত বোঝাপড়ার সময় লেখক হিসেবে নৃসিংহপ্রসাদ এক রকমের স্বাদেশিকতাবোধে উদ্দীপিত, তবে এই স্বাদেশিকতা কখনও পরিশুদ্ধ জাতি নির্মাণবিলাসীদের মতো প্রবৃত্তিকে দমন করতে চায় না। আবার রিচার্ড বার্টনের মতো কামসূত্র ও শাস্ত্র অনুবাদকারী সাহেবদের মতো ‘রোম্যান্টিক’ ভাবুকতায় তিনি বিভোর নন। বরং ‘মজঝিম পন্থা’ তাঁর অবলম্বন। লেখক হিসেবে তিনি মনুর অনুরক্ত ভক্ত, একথা বলার উপায় নেই। মনুর বিধিবিধানের তৎকালীন উপযোগবাদটুকুকে খেয়াল করিয়ে দিয়েছেন। “ভারতবর্ষের ধর্মীয় এবং সামাজিক ইতিহাস মানেই ভোগ আর বৈরাগ্যের এক অদ্ভুত দ্বৈরথ” (পৃ.১১০) টানাপড়েন কেবল প্রবৃত্তি আর নিবৃত্তির নয়, বিধি আর স্বাধীনতার, ইচ্ছার আর না-ইচ্ছার জটিল সে এক রসায়ন।
খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা শ্রীভাদুড়ী এখানে খেয়াল করিয়ে দিয়েছেন। যৌনতা কেবল দুই নারী-পুরুষের শরীরের ওপর নির্ভর করে না সেখানেও প্রাদেশিকতা আছে। প্রাচীন ভারতের রমণীরাও প্রাদেশিকতা ও সংস্কৃতি ভেদে ভিন্ন ভিন্ন। কাজেই ভারত-রমণীর এক রকম আদর্শ নির্মাণের প্রচেষ্টা কেউ করতেই পারেন— তবে তাতে ভিন্নতা আর বৈচিত্রের রূপটি খণ্ডিত হবে।
নিবন্ধগুলিতে নৃসিংহপ্রসাদের কলমের সব চিহ্নই স্পষ্ট। রসিকতা, কৌতুক, সাম্প্রতিক ঘটনার প্রসঙ্গ সবই এসেছে। ফলে এই কথকতা পড়তে পাঠকের বেশ লাগে। লেখার মধ্যে কথার চাল নিয়ে আসা নৃসিংহপ্রসাদের রীতি। যেন রসিয়ে গপ্পো করছেন আর কথক ঠাকুরের কথা শুনছেন আবিষ্ট শ্রোতা। তবে গুণই তো কখনও কখনও দোষ। অনেক সময় কথা বলার চালে কোনও প্রসঙ্গ নিতান্ত কথার কথা হয়ে উঠেছে, প্রয়োজনীয় তথ্য আর বিশ্লেষণ শ্রোতা পাঠকের কাছে পেশ করা হয়নি। কোনও কোনও নিবন্ধে তথ্যসূত্র আছে কোথাও নেই। এই সব অসমতা নিয়েই পরম-রমণীয় বই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.