দক্ষিণ কলকাতা: বেহালা
অন্য ক্রিকেট
আলোকিত প্রাঙ্গণ
হায়দরাবাদের উপ্পলই কি তারুণ্য আর রোমান্সের সাক্ষী হয়ে রইল?
বেহালার অক্সফোর্ড মিশন স্পোর্টস কমপ্লেক্সের মাঠে কি তার পুনরাবৃত্তি হল না?
না, উপ্পলে ভারত-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট ম্যাচের গ্ল্যামার আর আকর্ষণের আলোকবৃত্তের সঙ্গে একেবারেই তুলনীয় না হলেও অন্য এক আলোয় উজ্জ্বল হয়ে রইল অক্সফোর্ড মিশন স্পোর্টস কমপ্লেক্সের মাঠ। বেঙ্গল ব্লাইন্ড ক্রিকেট অ্যান্ড স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত এই ক্রিকেটে যাঁরা অংশ নিলেন তাঁরা সকলেই দৃষ্টিহীন। এমনকী, দর্শকদেরও অধিকাংশ দৃষ্টিহীন!
বাংলা, বিহার, ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ডকে নিয়ে পূর্বাঞ্চলীয় এই ক্রিকেটে বাংলাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হল বিহার। ফাইনালে সবার নজর কেড়ে নিলেন চ্যাম্পিয়ন দলের অলরাউন্ডার মহম্মদ ফয়জল। গয়ায় বেড়ে ওঠা আংশিক দৃষ্টিহীন ছেলেটি এখন আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লাইন্ড স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। ১১১ রানের দুরন্ত একটি ইনিংস খেলে প্রায় একাই তিনি বাংলাকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেন। ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার পান তিনিই। এর আগে লিগ ম্যাচে ঝাড়খণ্ডের বিরুদ্ধে ১৮০ রানের লম্বা ইনিংস খেলেছিলেন ফয়জল। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির ভক্তটি বললেন, “আমি ভারতের হয়ে খেলতে চাই।”
টসে জিতে বাংলার অধিনায়ক অভিজিৎ মণ্ডল বিহারকে ব্যাট করতে পাঠান। ২০ ওভারে ফয়জলের ব্যাটে ভর করে বিহার তোলে ২৪৯ রান। জয়ের জন্য ২৫০ রানের লক্ষ্য নিয়ে ব্যাট করতে নামে বাংলা। সাত ওভারে ১০০ রান তুলে বাংলার খেলোয়াড়েরা যখন জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন, ঠিক তখনই আঘাত হানে বিহার। একে একে উইকেটের পতন ঘটতে শুরু করে। রতন দে ৪২, অরবিন্দ পাত্র ২৮, প্রসেনজিৎ আদক ২৪ রানে ফিরে যেতেই জয়ের কাছে পৌঁছে যায় অধিনায়ক সাহিদ রাজার বিহার। শেষ দিকে বাংলা লড়াই করেও আট উইকেটে ২৩২ রানের বেশি তুলতে পারেনি। ১৭ রানে ম্যাচ জিতে জয়ের উল্লাসে মেতে ওঠেন ফয়জল, ওয়াসিম তালিবরা।
কেমন করে হয় এই ক্রিকেট? আয়োজক সংস্থার সচিব দৃষ্টিহীন রাজা ফৈয়াজ আলম জানালেন, ৪০ এবং ৬০ শতাংশ দৃষ্টি হারিয়েছেন এমন চার জন করে মোট আট জন খেলোয়াড় প্রতি দলেই থাকেন। বাকি তিন জন থাকেন সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন খেলোয়াড়। শক্ত প্লাস্টিকের সাদা বল এবং স্টিলের পাইপের সাদা উইকেট দিয়ে খেলা চলে। বলের মধ্যে ছোট ছোট লোহার বল বেয়ারিং দেওয়া থাকে। শব্দ শুনে খেলোয়াড়েরা বলের অবস্থান বুঝতে পারেন। স্টিলের উইকেটে বল লাগলে শব্দ বোঝা যায়। ২২ গজের উইকেটের মধ্যে ১১ গজ বরাবর আড়াআড়ি ভাবে একটা সাদা দাগ টানা থাকে। বোলারকে সাদা দাগের আগে একটা ড্রপ দিয়ে মাটিতে গড়িয়ে আন্ডার আর্ম বল করতে হয়। সাধারণ আম্পায়াররাই ম্যাচ পরিচালনা করেন।
এই প্রথম বাংলায় ভিন রাজ্যের দল নিয়ে হল দৃষ্টিহীনদের ক্রিকেট। এই তথ্য জানিয়ে আয়োজক সংস্থার সচিব আক্ষেপ করে বললেন, “কর্নাটক, হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্য দৃষ্টিহীনদের ক্রিকেটে আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। ওখানে পৃষ্ঠপোষক আছেন। সাধারণ মানুষের সমর্থন আছে। অথচ বাংলায় দৃষ্টিহীনদের ক্রিকেট নিয়ে তেমন কিছুই হয় না। আমরা সবে শুরু করেছি। গত বছরই পাকিস্তানকে হারিয়ে দেশের মাটিতে দৃষ্টিহীনদের টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছে ভারত। বাংলায় অনেক প্রতিভা আছে। কোচ হিসাবে পেয়েছি সুরথ মজুমদারকে। আমরা চাই এখান থেকে ভাল খেলোয়াড় উঠে আসুক। প্রয়োজনে আমরা সি এ বি-র সহযোগিতা চাইব।”
পুরস্কার তুলে দিতে এসে রাজ্যের শিল্পবাণিজ্য মন্ত্রী এবং স্থানীয় বিধায়ক পার্থ চট্টোপাধ্যায় আগামী বছর দৃষ্টিহীনদের এই ক্রিকেট প্রতিযোগিতা আরও বড় আকারে করার জন্য সব রকম সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ট্রফি ছাড়াও চ্যাম্পিয়ন দল পায় ১৬ হাজার টাকা। রানার্স বাংলা পেল ১০ হাজার টাকা। সহযোগী সংস্থা ভয়েস অব ওয়ার্ল্ডের অধ্যক্ষ সুকুমার চক্রবর্তী বললেন, “আমরা চাই দৃষ্টিহীনদের ক্রিকেট নিয়ে আরও ভাবনাচিন্তা হোক।” আর এক সহযোগী স্থানীয় বড়িশা ক্লাবের পক্ষে সঞ্জয় মিত্র বললেন, “দৃষ্টিহীনরা কী ভাবে ক্রিকেট খেলেন, আমাদের অনেকেরই জানা ছিল না। ওঁদের আরও সুযোগ দরকার।”
ক্ষীণদৃষ্টি? সে তো বহিরঙ্গে! ২২ গজও যে এ ভাবে লড়াকু জীবনের প্রতীক হয়ে যেতে পারে, কে জানত!

ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.