দক্ষিণ কলকাতা
দারাপাড়া
আতঙ্কের দিনরাত্রি
কসঙ্গে গোছাখানেক বিদ্যুতের তার, এক পোস্ট থেকে আর এক পোস্টে টানা। জায়গায় জায়গায় তারের সংখ্যা এতটাই বেশি যে তারের ভারে নামতে নামতে মাথার একটু উপর দিয়েই গিয়েছে তারের গোছা। শুধু কি তাই? অলিগলির ভিতর দিয়ে যে ভাবে তার টানা হয়েছে, তাতে যে কোনও সময়ে শর্ট-সার্কিট হয়ে আগুন লেগে যেতে পারে। আর এই এলাকায় আগুন লাগলে ক্ষতির পরিমাণ কী দাঁড়াবে তা এলাকার মানুষ জানেন। তবু কারও কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। এই ভাবেই ভয়াবহ পরিবেশে দিন কাটাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ।
এই দৃশ্য পার্ক সার্কাস চার নম্বর ব্রিজ সংলগ্ন দারাপাড়া এলাকার।
পার্ক সার্কাস স্টেশন লাগোয়া তিলজলা রোডের বস্তি দারাপাড়া। চার নম্বর ব্রিজ থেকে নেমেও পৌঁছনো যায় বস্তিতে। কিন্তু ব্রিজের নীচ দিয়ে যে রাস্তা, তা দিয়ে দমকলের বড় গাড়ি তো দূর-অস্ত, একটু উঁচু গাড়িও ঢুকতে পারবে না। অথচ বস্তিতে বিদ্যুতের তারের যে জাল, তাতে এক বার শর্ট-সার্কিট থেকে আগুন লেগে গেলে মুহূর্তে ভস্মীভূত হয়ে যেতে পারে পুরো বস্তি। এই অভিযোগ বস্তিরই একাধিক বাসিন্দার।
অলিগলির ভিতরে এ ভাবে বসতবাড়ির গা দিয়ে বিদ্যুতের তার টানার অনুমতি কে দিল? দমকলই বা কী করছে? কলকাতার অন্যান্য এলাকায় মাটির তলা দিয়ে বিদ্যুতের লাইন গেলেও এই বস্তিতে কেনই বা ওভারহেড লাইন নিয়ে যাওয়া হয়েছে?
সিইএসসি কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, এখন যে মিটারগুলি লাগানো হয়েছে, সেগুলির উপর আলাদা করে স্টিলের পাইপ দিয়ে সুরক্ষিত করে দেওয়া হয়েছে। ফলে এমনিতে শর্ট সার্কিট হওয়ার আশঙ্কা নেই। যদিও গোটা পরিস্থিতি নিয়ে একে অন্যকে দোষারোপ করছেন। কাউন্সিলর বলছেন, সিইএসসি বাড়ি বাড়ি মিটার দিতে রাজি হচ্ছে না বলে এই অবস্থা। আর সিইএসসি কর্তৃপক্ষ বলছেন, ওই বস্তিতে এক একটি বহুতলে এত পরিবার থাকেন যে, তাঁদের আলাদা করে মিটার দেওয়া যেমন সমস্যার, তেমনই এই এলাকার অনেকে হুকিং করে এত লাইন নিয়ে রেখেছেন যে কেউ আর বৈধ লাইন নিতে উৎসাহী হন না। আগে বহু বার সিইএসসি থেকে লোক গিয়েছে হুকিং লাইন কাটতে, কিন্তু সব সময়েই এলাকার মানুষের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে তাঁদের।
হুকিং করে লাইন নেওয়ার কথা স্বীকার করে ৫৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সিপিএমের দেবাংশু রায় বলেন, “এক সময় এলাকায় এত হুকিং হয়েছে যে সিইএসসি কোটি কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছে। এর পরেই তারা বক্স মিটার বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সেখানেও বাসিন্দারা বক্স মিটারের বিরুদ্ধে। কেননা, একটি বক্সমিটার থেকে অনেকগুলি পরিবারকে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। তাতে কার কত বিল দাঁড়াচ্ছে, সেটা নিয়েই শুরু হচ্ছে ঝামেলা। এমনকী, অনেক সময়েই তাঁরা বক্স মিটারের বিল মেটাচ্ছেন না। তাই বছরখানেক হল পর্ষদ বক্স মিটার দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।”
যদিও এলাকাবাসীর দাবি, এই মুহূর্তে এই বস্তিতে কয়েকটি বাড়িতেই মাত্র হুকিং করে বিদ্যুতের লাইন টানা রয়েছে। বেশির ভাগ বাড়িতেই সিইএসসি বক্স মিটার বসিয়ে দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাতেও কতটা সুরক্ষিত বাড়িগুলি? জানা গেল, একটি বক্স মিটার থেকে কমবেশি ১০ থেকে ১৫টি বাড়িতে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। সেখানেও বক্স মিটার নেওয়ার পরে কেউ কেউ ওভারহেড থেকে হুকিং করে লাইন টানছেন। ফলে হুকিং সমস্যা রয়েই গিয়েছে।
চার নম্বর ব্রিজ সংলগ্ন কলকাতা পুরসভার ৫৯ নম্বর ওয়ার্ডের এই দারাপাড়া বস্তিতে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের বসবাস। কলকাতার বিভিন্ন বাজারগুলিতে বার বার আগুন লাগার পরে প্রশ্ন উঠেছে, এই ধরনের বস্তিগুলিই বা কতটা নিরাপদ?
মেয়র পারিষদ (বস্তি) স্বপন সমাদ্দার বলেন, “সিইএসসি-র আধিকারিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসব। বস্তির বৈদ্যুতিক তারের ওয়্যারিং যাতে তাঁরা ঠিক করেন, সেই অনুরোধ করব। ওয়্যারিং ঠিক করলে হুকিংয়ের প্রবণতা বন্ধ হবে। হুকিং থেকেই বস্তিতে আগুন লাগে।”
রাজ্যের দমকলমন্ত্রী জাভেদ খান পরিস্থিতির কথা স্বীকার করে বলেন, “মাস দেড়েক আগে পুর ও নগরোন্নয়ন দফতর এবং সিইএসসি-র সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। প্রস্তাব দিয়েছি, যাতে বস্তি এলাকার বিদ্যুতের সমস্ত লাইন মাটির তলা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এ নিয়ে আবারও বৈঠকে বসব।”
সিইএসসি কর্তৃপক্ষ জানান, এই এলাকায় ২০০৬-এ দু’টি বড় ট্রান্সফর্মার ছিল। কিন্তু গ্রাহকসংখ্যা ছিল মাত্র ৫১। এলাকায় ৯০ শতাংশের মতো বেআইনি সংযোগ ছিল। কিন্তু এর পরে পরিস্থিতি দেখে সিইএসসি একটি ট্রান্সফর্মার বন্ধ করে বাড়ি বাড়ি মিটার দিতে শুরু করে। কিন্তু যা অবস্থা তাতে বস্তির সব বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া সম্ভব ছিল না। পরে সিইএসসি নিজের খরচে বিভিন্ন জায়গায় ২২০০টি মিটার বসিয়েছে। যে লাইনগুলি উপর দিয়ে গিয়েছে, সেই তারগুলি ভাল করে রক্ষা করার ব্যবস্থা সত্ত্বেও সিইএসসি-র ভয়, ওই তার যদি মাঝখান থেকে কেটে কেউ লাইন নেয়, তা হলে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.