|
|
|
|
|
|
|
হাঁড়ির খবর |
পিৎজা-ভূমে হানাদারি
ঋজু বসু |
|
বঙ্গজীবনে আদি পিৎজা কী?
বুদ্ধদেব বসুর ‘তিথিডোর’ মনে থাকলে জবাব খুঁজতে বেশি ধকল হবে না। সে-দিন চমৎকার রোদেলা দুপুরে পার্ক হোটেলের দ্য ব্রিজে খোলা আকাশের নীচের ডেকে বসে প্রশ্ন ও উত্তর দু’টোই তড়াক করে মগজে লাফিয়ে উঠল। পাতে স্যালাড-পিৎজার দেখা পেতেই আমার বিয়েবাড়ির শেষ পাতে চাটনি-পাঁপড়ের কথা মনে এসেছে। কিংবা পাঁপড়ের সঙ্গে দই, ছানার পায়েস কি মাখা সন্দেশ। ছোট-ছোট টুকরো পাঁপড় শুধুমুদু খাওয়া চলে! আবার চাটনি বা অন্য ডেজার্ট চাখার সময়ে চামচের কাজও করবে। এ চামচ শূন্য পাতে পড়ে থাকবার নয়! কুড়মুড়িয়ে খেয়ে ফেলবার চামচ। ‘চামচে’র টপিংটা জিভ দিয়ে সাপ্টে নেওয়া যায়। আবার একসঙ্গে চামচসুদ্ধুও মুখে পুরে ফেলা চলবে। একে পিৎজা ছাড়া আর কী বলা চলে?
বাঙালির এই ভোজন-রীতির কথা জানলে খাঁটি পিৎজাখোর ইতালিয়ানও বেরাদরি অনুভব করতেন। ইতালিয়ান স্যালাড পিৎজা বা ডেজার্ট পিৎজা, দু’টোই যেন বাঙালির চাটনি-পাঁপড়ের যুগলবন্দি। পাঁপড়প্রতিম পিৎজার গায়ে নানা কিসিমের স্বাস্থ্যকর সবুজের সমারোহ, সামান্য চিজ, এক-আধটা সেঁকা কাজু ও স্ট্রবেরিকুচির অলঙ্কার। ক্যালরি-সচেতন জনগণ ইদানীং এই সহজ, সুন্দর বস্তুটির খোঁজ করছেন। |
|
ডেজার্ট পিৎজা অবশ্য ব্রিজে নেই। লালচে চিনির পাতে জ্যাম ও ফলের কুচি ধারণ করে সেই পিৎজার বেশভূষা। এই ধরনের যে কোনও পিৎজা দেখলেই আম-বাঙালির বিয়েবাড়ির ‘ডেজার্ট পিৎজা’ চাটনি-পাঁপড়ের কথা মনে পড়বেই।
তবে দেড়-দু’দশক আগেও এই তল্লাটে পিৎজা-অভিজ্ঞতা ঠিক এ রকম ছিল না। আর একটু পিছনে আশির দশকের শেষে খোলা স্যান্ডউইচ আর পিৎজার মধ্যে ক’জনই বা ফারাক বুঝতেন? ইয়া মোটা পাঁউরুটির জমিতে একটু টমেটো সস, ধনেপাতা, চিজ-টিজ ঢেলে নাহুমের পিৎজা তখন ঘরে ঢুকতে শুরু করেছে। পিৎজার মধ্যবিত্তকরণে এর পরে এগিয়ে আসবে মনজিনিস! ভুবনায়ন-পরবর্তী যুগে পিৎজাহাট, ডমিনোজ-এর ফাস্ট ফুডচেন কলকাতায় শাখা বিস্তার করলেও প্রকৃত পিৎজার সোয়াদ তখনও অধরাই থেকে গিয়েছে।
তবে শহুরে বাঙালির ঘরে-ঘরে এনআরআই আত্মীয় বাড়তে থাকায় ইয়া মোটা পুরু জমির পিৎজার প্রতি অনীহাও তখনই তৈরি হতে শুরু করেছে। যথার্থ থিন-ক্রাস্টের স্বাদ এক বার পেলে সেকেলে পিৎজা মুখে তোলা মুশকিল। বছর তিন-চার হল পিৎজা-মানচিত্রে কলকাতা অনিবার্য ভাবে মর্যাদার স্থান ছিনিয়ে নিয়েছে। তখন পার্কের দ্য ব্রিজে আমেরিকা থেকে লোকলস্কর এনে কাঠের আঁচের ঢাউস আভেনটা বসানো হয়। থিন ক্রাস্ট বা পাতলা জমির পিৎজা গড়ার কাজে যা ছিল অনুকূল। একই সময়ে শহরের অন্য পাঁচতারাগুলোর পিৎজাতেও পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। কলকাতার পিৎজা-ভুবনে আর এক তারকার নাম আফরা। সল্টলেকে, রাজারহাটে আফরা-র পিৎজাও অবলীলায় দিল্লি-বেঙ্গালুরুর মতো মেট্রো-নগরীকে টেক্কা দেবে। প্রকৃত পিৎজা-রসিক এখন ডমিনোজ, পিৎজাহাটে গেলেও পারতপক্ষে থিন-ক্রাস্ট ছাড়া অর্ডার করেন না। কিন্তু সেখানে মুশকিলটা হল, থিন-ক্রাস্ট পিৎজা চাইলে শুধুমাত্র মাঝারি মাপের পিৎজাই (মিডিয়াম) নিতে হবে। এক জনের খাওয়ার মতো ছোট পিৎজা বা বৃহৎ ফ্যামিলি সাইজে থিন-ক্রাস্ট এখনও দুর্লভ।
|
|
সেকেলে পিৎজায় নামমাত্র টপিং-ছায়ায় শুকনো বানরুটি চিবুতে চোয়াল ব্যথা হওয়ার জোগাড়। থিন ক্রাস্টে পিৎজার টপিং-বৈচিত্র্য আরও মহিমময়। তন্দুরি চিকেন বা চিকেন টিক্কা টপিংয়ের ফিউশনের কথা বলছি না। সে-সব এখন ক্লিশে। মাটন কিমার টপিংও ঢের পুরনো। কলকাতার অন্যতম বিশিষ্ট পিৎজা-ক্ষেত্র ফায়ার অ্যান্ড আইস, দীর্ঘ দিন মশলাদার কিমায় ফায়ার অব বেঙ্গল নামের এক রাজকীয় পিৎজা বানায়। আর আফরা-য় মিহি পিৎজা-ভূমিতে কিমা ও অলিভের যুগলবন্দি গাদা-গাদা বিয়ারের সঙ্গে উড়িয়ে দেওয়ার মধ্যেও একটা অদ্ভূত সার্থকতা। ইদানীং অবশ্য স্বাস্থ্যচিন্তার ঝোঁকটাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই ব্রিজের স্যালাড পিৎজা-টিজার জোর কদর।
কিন্তু পিৎজা যদি খেতেই হয়, তবে ক্যালরি নিয়ে বেশি পিটপিটে হওয়া নিরর্থক। দ্য ব্রিজের পিৎজা মেনু ঘাঁটলেও আমার অন্তত ডায়েট-বিধি শিকেয় তুলে দিতে ইচ্ছে হয়। ধ্রুপদী পিৎজার গোত্রেই ধরা যাক, রাস্টিকা বা ৪x৪ পিৎজার কথা। প্রথমটিতে অলিভ-রসুন-আর্টিচোকাদির সঙ্গে ঈষৎ নোনতা বিদেশি হ্যাম প্রসিতো। আর ৪x৪ পিৎজা মানে, চার ধরনের চিজ ও চার রকম কোল্ডকাট মাংস সসেজ, বেক্ন, পেপারনি, প্রসিতোর সমাহার। এই স্বাদে এক দিন লাগামছাড়া বুঁদ হতে দশ দিন কৃচ্ছ্রসাধন করে প্রস্তুতি নেওয়া যায়।
পিৎজায় যারা অন্য ধরনের স্বাদ খুঁজছেন, দ্য ব্রিজ তাঁদেরও ফেরায় না। শাকাহারি পিৎজার মধ্যে ন্যাসপাতি ও গরগনজোলা চিজের একটি বিশেষ পিৎজা মিলবে। নীলচে গরগনজোলা চিজ শুধু মুখে সামাল দেওয়া কঠিন। তীব্র গন্ধ! কিন্তু শেফের হাতযশে পিৎজায় লালচে পেঁয়াজ, ন্যাসপাতি, মোজারেলা চিজের সঙ্গে দিব্যি মিলেজুলে গিয়েছে। অলিভ, ফেতা চিজ-টিজে গ্রিক পিৎজাও মনোজ্ঞ অভিজ্ঞতা।
পার্কের শরদ দিওয়ান ও সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শেফেরা চিরকেলে মেতেছেন। সুরজিৎ বলছিলেন, এ হল আমাদের ‘ডিউড্স পিৎজা’। একেলে আধুনিক মননকে যা ছুঁয়ে যাবে। টেক্সাসের ফাস্ট ফুডের স্টেক সস বা বাঙালির প্রিয় চিনে-স্বাদ হট চিলি সস হয়ে উঠেছে এই পিৎজার আভরণ। স্পাইসি শ্রিম্প পিৎজায় কুচো চিংড়িযোগে ঝাল-ঝাল চিনে-স্বাদের পিৎজা এ বারের আবিষ্কার। রাজমার মতো বিনপেস্ট, হালাপিনো লঙ্কা, চিকেনযোগে মেক্সিকান পিৎজাও নতুনত্ব। কলকাতা শহর জুড়ে আফরার বিভিন্ন ডেলি শপেও ইদানীং বেশ নতুন ধরনের পিৎজা মিলছে।
পিৎজা আদতে চটজলদি খাবার। রান্নায় ছুটি নিতে এক রাত্তিরের খোরাক বই কিছু নয়! এ ধারণাটা এখন পুরনো। শেফের কল্পনাশক্তির দৌড়ে এই ফাস্ট ফুডও যে রসোত্তীর্ণ হয়ে উঠতে পারে, তা টের পাচ্ছে আজকের কলকাতা।
|
ছবি: শুভেন্দু চাকী |
|
|
|
|
|