পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে তুঙ্গে উঠল রাজ্য সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মধ্যে সংঘাত। শেষ বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার প্রস্তাব দিয়েছিল, দুই পর্বে এবং ভিন্ রাজ্যের পুলিশ দিয়ে ভোট করানো হোক। কিন্তু আগের দু’বারের মতো এ বারেও রাজ্যের সেই প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছে কমিশন। বৃহস্পতিবার মহাকরণে চিঠি পাঠিয়ে কমিশন জানিয়ে দিয়েছে, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের স্বার্থে তিন দফায় ভোট করা দরকার এবং তা কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করেই। রাজ্য সরকার তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করুক।
বারবার তিন বার ‘না’। এ দিন তাই কমিশনের চিঠি পেয়ে ক্ষুব্ধ মহাকরণ। মহাকরণ সূত্রে খবর, এই অবস্থায় কমিশনের সঙ্গে আর আলোচনা না করে একতরফা ভাবে ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণা করার জন্য পঞ্চায়েত দফতরকে এগোনোর নির্দেশ দিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর দফতর। আপাতত কলকাতার বাইরে থাকা পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় জানান, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে সরকারের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে।
যদি রাজ্য দু’দফায় ভোটের কথা ঘোষণা করে দেয়, তা হলে কী হবে? অনেকেরই আশঙ্কা, সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনও রাজ্যকে জানিয়ে দিতে পারে, স্রেফ রাজ্য পুলিশ দিয়ে এক বা দু’দফায় ভোট করাতে তারা অপারগ। কারণ, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব কমিশনেরই। আর তা হলে তৈরি হতে পারে অভূতপূর্ব অচলাবস্থা। তখন লড়াই আদালত পর্যন্ত গড়ানোরও আশঙ্কা করছেন অনেকে।
কমিশনের এক মুখপাত্রও এ দিন বলেন, “দিন ঘোষণা করার এক্তিয়ার যেমন পঞ্চায়েত দফতরের হাতে, ঠিক তেমনই ভোট পরিচালনার ভার কমিশনের। আইনে বলা রয়েছে, ভোট পরিচালনার উপযুক্ত পরিবেশ না থাকলে রাজ্য নির্বাচন কমিশন তা সরকারকে জানিয়ে দিতে পারে। রাজ্য যে ভাবে চাইছে, তাতে শান্তিতে ভোট সম্ভব নয়।” অন্য দিকে, মহাকরণে এক সরকারি মুখপাত্র জানান, আইন অনুযায়ী পঞ্চায়েত দফতরই দিন ঠিক করার অধিকারী। পঞ্চায়েত আইনের ৪২ ধারা মেনে সরকার চাইলে দিনক্ষণ ঘোষণা করে দিতে পারে। কিন্তু ওই আইনের ৪৩ নম্বর ধারাতেই বলা হয়েছে, দফতরের সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে সরকারকে তা পুনর্বিবেচনা করতে বলতে পারে কমিশন। সে ক্ষেত্রে আবার কমিশন-মহাকরণ আলোচনা শুরু হতে পারে। |
পঞ্চায়েত আইন |
৪২ নং ধারা
দিন ঘোষণা করতে পারে সরকার।
৪৩ নং ধারা
পছন্দ না হলে সরকারকে তা পুনর্বিবেচনা করতে বলতে পারে কমিশন। তখন আলোচনা শুরু হতে পারে। |
|
প্রশ্ন উঠেছে, গত আড়াই মাস ধরে যে টানাপোড়েন চলছে, তাতে নতুন করে আলোচনা শুরু হওয়া কি সম্ভব? পঞ্চায়েতমন্ত্রীও বলেছেন, “আমরা তো এক থেকে দু’দফায় এবং রাজ্য পুলিশের পরিবর্তে ভিন্ রাজ্যের পুলিশ আনতে রাজি হয়েছিলাম। কমিশন একরোখা মনোভাব দেখাচ্ছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে আমরাও একতরফা ভাবে ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা করে দেব।” প্রশাসনের একাংশের মত, এই কথায় সংঘাতের আভাস মিলছে।
কেন কমিশন বলছে, রাজ্যের প্রস্তাব মেনে পঞ্চায়েত ভোট করা সম্ভব নয়? কমিশনের তরফে বলা হয়েছে, রাজ্য পুলিশের ডিজি কমিশনকে জানিয়েছেন, সরকারের হাতে ৪৪ হাজার পুলিশ রয়েছে।
এই পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে অস্থায়ী হোমগার্ড, এনভিএফ দিয়ে ভোট করানো সম্ভব। সে জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রয়োজন নেই। পুলিশ প্রধানের এই দাবি মানতে রাজি নয় কমিশন। তাদের বক্তব্য, পঞ্চায়েত ভোটে প্রায় ৫৯ হাজার বুথ হবে। অথচ রাজ্যে সাকুল্যে পুলিশের সংখ্যা ৪৪ হাজার। সুতরাং প্রতি বুথে এক জন পুলিশও মোতায়েন করা যাবে না। কমিশন মনে করছে, জেলাগুলির আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে যে রিপোর্ট এসেছে, তাতে প্রতি বুথে সশস্ত্র পুলিশ না রেখে ভোট করা যাবে না। এই যুক্তিতেই কমিশন ৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী রেখে তিন দফায় ভোট চায়। যদিও কমিশনের এই মত মানতে চাননি সুব্রতবাবু।
ভিন রাজ্য থেকে পুলিশ আনার ব্যাপারে আশা দেখছে না কমিশন। কমিশন সূত্রে বলা হয়েছে, ভিন রাজ্য থেকে তখনই পুলিশ পাওয়া সম্ভব যখন পশ্চিমবঙ্গ অন্য সময় তাদের পুলিশ দিয়ে সাহায্য করবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সাধারণত অন্য রাজ্যকে পুলিশ দিয়ে সাহায্য করে না।
কমিশন চিঠিতে জানিয়েছে, তিন দফায় ভোট না হলে প্রতি বুথে পুলিশ দেওয়া যাবে না। কমিশন তিন দফার তিনটি দিন নির্দিষ্ট ভাবে উল্লেখ করেনি। তবে ১৫ মার্চ পর্যন্ত ভোট সংক্রান্ত কাজ চলবে। তার পর বিজ্ঞপ্তি জারি করে বিধি অনুযায়ী ৪২ দিন ছেড়ে ভোটের প্রথম দিনটি যে ২৭ এপ্রিলের আগে হবে না, তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। রাজ্য ২৪ এবং ২৭ এপ্রিল ভোটের দু’টি দিন প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু ২৪ এপ্রিল ভোট করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে কমিশন।
আড়াই মাস আগে পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডের সঙ্গে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিদের প্রথম মুখোমুখি আলোচনা হয়। তখন কমিশন জানায়, ভোটার ও বুথের সংখ্যা অনেকটা বেড়ে যাওয়ার ফলে এবং রাজ্যের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রাখলে ৮০০ কোম্পানি সশস্ত্র বাহিনী প্রয়োজন। তারা প্রস্তাব দেয়, প্রথম দফায় উত্তরবঙ্গ, দ্বিতীয় দফায় জঙ্গলমহল-সহ বর্ধমান-বীরভূম এবং শেষ দফায় মালদহ, মুর্শিদাবাদ-সহ দক্ষিণবঙ্গের বাকি জেলাগুলিতে ভোট হোক।
সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়ের কাছে পঞ্চায়েত ভোটের দিনক্ষণ এবং পুলিশি ব্যবস্থা নিয়ে মতামত চেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ডিজি জানান, এক দফায় পঞ্চায়েত ভোট করাটাই সুবিধাজনক হবে। ২০০৩ সালেও পঞ্চায়েত ভোট হয়েছিল এক দফায়। ২০০৮ সালে তিন দফায় ভোট হলেও সেই সময় হিংসা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল সব চেয়ে বেশি। ফলে এক দিনে ভোট হলে হিংসাত্মক ঘটনা যা হবে, এক দিনেই হবে। তা ছাড়া, একাধিক দফায় নির্বাচন হলে ভোট-গুন্ডারা নানা জায়গায় গিয়ে গোলমাল পাকায়। রাজনৈতিক দলগুলি দু-তিন দফাতেই তাদের ব্যবহার করতে চায়।
ডিজি-র নোটে আপত্তি করেননি মুখ্যমন্ত্রীও। মুখ্যমন্ত্রীর দফতর থেকে পঞ্চায়েত দফতরকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা যেন সরকারের মনোভাব কমিশনকে জানিয়ে দেয়। সেই থেকেই সংঘাত চলছে। জটিলতা কাটাতে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের দ্বারস্থ হন মীরা পাণ্ডে। কমিশনের যুক্তির সঙ্গে সহমত পোষণ করে রাজ্যপাল ডিজি ও মুখ্যসচিবকে জানান, জেদাজেদি না করে সমাধানের পথ খোঁজা হোক। কিন্তু এ দিনের পর স্পষ্ট হয়ে গেল, সমাধান দূর অস্ত। |