বন্ধ-অবরোধের কর্মনাশা রাজনীতির বিরোধিতা করিয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিপূর্বেই রাজ্যবাসীর কৃতজ্ঞতাভাজন হইয়াছেন। তাঁহার বিরোধিতা যে তাত্ত্বিক বা মৌখিক নয়, কেবল ‘কথার কথা’ নয়, কাজে-ফাঁকি-দেওয়া কিংবা গরহাজির সরকারি কর্মচারীদের ছুটি ও বেতন কাটার মতো কঠোর প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত লইয়া মুখ্যমন্ত্রী তাহা বুঝাইয়াও দিয়াছেন। হাতে-নাতে এই কড়াকড়ির সুফলও মিলিতে শুরু করিয়াছে। উপরন্তু কর্মসংস্কৃতি ফিরাইতে বিধানসভার বাজেট অধিবেশনে উপর্যুপরি আরও দুইটি বিল আনার সিদ্ধান্ত মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করাইয়া মুখ্যমন্ত্রী এ ব্যাপারে তাঁহার সঙ্কল্পবদ্ধতার পরিচয় দিলেন। একটি সিদ্ধান্ত হইল, নূতন চাকুরি পাইয়া অন্তত তিন বছর অস্থায়ী কর্মী হিসাবে অর্ধেক বেতন লইয়া পূর্ণ দক্ষতা সহ কাজের প্রমাণ দিয়া তবে স্থায়ী হইতে হইবে। দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত জনসাধারণকে সময়মতো পরিষেবা প্রদান সংক্রান্ত—র্যাশন কার্ড, জন্ম-মৃত্যুর শংসাপত্র, জমির চরিত্র-বদল, গাড়ি চালাইবার লাইসেন্স ইত্যাদি পরিষেবা যাহার অন্তর্ভুক্ত। প্রাপ্য এই পরিষেবাগুলি পাইতে জনসাধারণকে যাহাতে আর হয়রান হইতে না হয়, ভারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মীরা যাহাতে জনগণকে হেনস্থা করিতে না পারেন, সে জন্যই এই বিল। ভুক্তভোগী জনসাধারণ নিশ্চয়ই মুখ্যমন্ত্রীর দুই সিদ্ধান্তকেই উদ্বাহু অভিনন্দন জানাইবেন।
বস্তুত, কর্মসংস্কৃতি ফিরাইবার কথা মুখে ইতিপূর্বে তাঁহার পূর্বসূরিরাও বলিয়াছেন। প্রসঙ্গত প্রয়াত জ্যোতি বসুর সখেদ আক্ষেপ মনে পড়িতে বাধ্য, সরকারি দফতরের শূন্য চেয়ারগুলির দিকে চাহিয়া যাঁহার হতাশাগ্রস্ত উক্তি, ‘কাহাকে কাজ করিতে বলিব, চেয়ারকে?’ উত্তরসূরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অভিজ্ঞতাও স্বতন্ত্র নয়। কর্মসংস্কৃতি ফিরাইতে আন্তরিক আগ্রহী বুদ্ধদেববাবুই ‘ডু ইট নাউ’ অর্থাৎ ‘এখনই করুন’ স্লোগানটির রচয়িতা। কিন্তু সরকারি কর্মচারীদের বামপন্থী সংগঠন কো-অর্ডিনেশন কমিটি সহ সিপিআইএমের বিভিন্ন শ্রমিক-কর্মচারী সংগঠন কাজের সময় আন্দোলন করাকেই নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার ভাবিতে অধিকতর অভ্যস্ত ছিল। ফলে বুদ্ধদেববাবুর স্লোগান তাঁহার দলীয় সমর্থক সরকারি কর্মীদের মধ্যেই হাসি-ঠাট্টার বিষয় হইয়া ওঠে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও রাজ্যের শাসনভার গ্রহণের পর হইতেই কর্মসংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়া আসিতেছেন, এবং সেগুলিও ঠিক একই ভাবে অমান্য করা হইয়াছে। সরকারি কর্মীরা যে দয়া করিয়া পরিষেবা দিতেছেন, এই দীর্ঘ বহমান সংস্কৃতিতে এতটুকু টোল পড়ে নাই। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই মুখ্যমন্ত্রীর অধৈর্য ও নূতন সিদ্ধান্ত।
তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এক কথা, সিদ্ধান্ত কার্যকর করা আর এক। ভারতের প্রশাসনিক ইতিহাসে সাধু উদ্যোগ কিংবা মহৎ সিদ্ধান্তের কোনও কমতি নাই, কিন্তু প্রায় কোনওটিই কার্যকর করিবার পদ্ধতি সাধারণ ভাবে কাহারও জানা নাই। এই সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, গুজরাতে নরেন্দ্র মোদী কিংবা বিহারের নীতীশকুমার তাঁহাদের রাজ্যের আপেক্ষিক সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিরাট পরিবর্তন সাধন করিতে পারেন কেবল কঠিন প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত কার্যকর করিবার মাধ্যমেই। তবে পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব অতি-বিশিষ্ট প্রশাসনিক প্রেক্ষিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই পদক্ষেপ বিষয়ে এখনই বিশেষ আশাবাদী হওয়া মুশকিল। জনসাধারণকে হেনস্থা করিবার যে সংস্কৃতি সরকারি দফতরগুলিতে দীর্ঘ অনুশীলনে বাসা বাঁধিয়াছে, তাহা নির্মূল না হইলে, কিংবা পরিষেবা প্রদান যে কর্মীদের দয়ার দান নয় বরং জনসাধারণের গণতন্ত্রের অধিকার, তাহা প্রতিষ্ঠা না করিলে এ কাজ শুরু করাও অসম্ভব। কেবল মুখের কথায়, অনুরোধ-উপরোধে ইহা ঘটিবে না, সরাসরি পুরস্কার ও তিরস্কারের বন্দোবস্ত প্রয়োজন, যাহা মুখ্যমন্ত্রী সম্যক অনুধাবন করিয়াছেন। তবে সমস্যা এই যে, জনপ্রিয়তার রাজনৈতিক প্রয়োজনও যে তিনি বাস্তবিক অনুধাবন করিয়াছেন! তাঁহার নিজেরই কর্মদর্শনে ছুটির গুরুত্ব ক্রমান্বয়ে বাড়িতেছে, সরকারি ছুটির তালিকা দ্রুত দীর্ঘতর হইতেছে। ইহার সহিত তো কর্মসংস্কৃতি ফিরাইবার এই দীপ্ত প্রয়াস একেবারেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নহে। ঠিক কাজ করিতে নামিয়া ভুল পথ ধরিলে তো চলিবে না। |