|
|
|
|
দোরগোড়ায় এল বই, সদস্য বাড়ছে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারে |
সুব্রত গুহ • কাঁথি |
ধানখেত, পুকুর পাড় ঘেঁষে সরু মোরাম রাস্তা। সেই রাস্তা ধরেই এগিয়ে চলেছে ঘেরাটোপের ভ্যান রিকশা। তার মধ্যেই রয়েছে বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ থেকে সত্যজিৎ-শরদিন্দু, এমনকী হালফিলের কমিকস থেকে ম্যাগাজিনের ভাণ্ডার। এমন ভাবেই গত পনেরো বছর ধরে পাঠকের দোরগোড়ায় নানা স্বাদের বই পৌঁছে দিচ্ছে কাঁথির বহিত্রকুণ্ডা এলাকার এই ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার। |
|
রাজ্য জুড়েই পাঠকের অভাবে ধুঁকছে গ্রন্থাগারগুলি। ক্রমেই কমছে সদস্য সংখ্যা। সেখানে গত পনেরো বছর ধরে সপ্তাহে পাঁচ দিন এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে প্রায় দশ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সুদৃশ্য ভ্যানরিকশায় চলছে এই পরিষেবা। ১৯৯৭ সালে সূচনার সময় এই ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র দুশো। এখন তা বেড়ে হয়েছে হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে ৭২৫ জন সাধারণ সদস্য আর ৩২৬ জন শিশু সদস্য। মাসিক চাঁদা মাত্র এক টাকা। শুধু এটিই নয়, পূর্ব মেদিনীপুরের আরও তিনটি ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারকাঁথি দেশপ্রাণ ব্লকের কাজলা ফণিভূষণ গ্রন্থাগার, মির্জাপুরের সৎ সাহিত্য সম্মিলনী পাঠাগার, কাঁথি ১ ব্লকের ধানগাঁ জ্ঞানের আলো গ্রন্থাগারচলছে বহাল তবিয়তে। ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগারের সুবাদে বাড়ির দোরগোড়ায় পছন্দের বই চলে আসায় যারপরনাই খুশি দুরমুঠের স্কুল ছাত্র সুকোমল মণ্ডল থেকে শুরু করে জালালপুরের স্কুল শিক্ষিকা কাজল রানি দাস, ধাউড়িয়া বাড় সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতির কর্মী আশিস জানা থেকে গৃহবধূ কৃষ্ণা দাস। গ্রামে গ্রন্থাগার নেই বলে আর এলাকায় আক্ষেপ নেই কারও।
|
পূর্বে কর্মী-সঙ্কট,
ধুঁকছে গ্রন্থাগার |
মোট গ্রন্থাগার |
|
১২১ |
জেলা |
১ |
শহর |
১০ |
গ্রামীণ |
১১০ |
বন্ধ |
১৭টি |
কর্মী |
থাকার কথা |
আছে |
গ্রন্থাগারিক |
১২১ |
৫৯ |
গ্রন্থাগার সহায়ক |
১২ |
৮ |
অন্য |
১৩৭ |
৭৭ |
মোট |
২৭০ |
১৪৪ |
কর্মী সঙ্কটের বিষয়টি সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রশাসনের বিভিন্ন
মহলে বার বার জানিয়েও সুরাহা হয়নি। —অসীম পণ্ডা
(বঙ্গীয় সাধারণ গ্রন্থাগার ও কর্মচারী কল্যাণ সমিতির জেলা সম্পাদক) |
|
কাঁথি ৩ ব্লকের বহিত্রকুণ্ডায় ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের উদ্যোগ পূর্বাঞ্চল জনকল্যাণ সঙ্ঘ পাঠাগারের। অর্থ সাহায্য করেছে রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরি ফাউন্ডেশন। জনকল্যাণ সঙ্ঘের গ্রন্থাগারিক দীপক জানা বলেন, “রাজ্যের আটটি ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগারের এখানেই প্রথম এই পরিষেবা চালু হয়। এই ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার অত্যন্ত জনপ্রিয়। প্রাথমিক স্কুলের পড়ুয়া থেকে হাইস্কুলের শিক্ষক, কলেজ ছাত্রী থেকে গ্রামের গৃহবধূ, বেকার যুবক, ব্যাঙ্ককর্মীসকলেই সপ্তাহের নিদির্র্ষ্ট দিনে অপেক্ষা করে থাকেন পছন্দের বইয়ের জন্য।” বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা, রবীন্দ্রনাথের গোরা, শরৎচন্দ্রের মহেশ, সত্যজিতের ফেলুদার মতো বইয়ের সঙ্গে মেলে ছোটদের পাঠ্যবই, বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, এমনকী মেলে প্রতিযোগিতামূলক চাকরির পরীক্ষার বইও। বই বিমুখতার যুগে এটাই এই ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। সব বয়সের, সব পেশার মানুষের চাহিদা অনুযায়ী বইয়ের যোগান রয়েছে ভ্রাম্যমাণ এই গ্রন্থাগারে। |
ভেঙে পড়েছে টালির চাল। সেই চালের নীচেই পাশাপাশি চলছে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র ও পাঠাগার।
পাঠাগারের
সম্বল বলতে ভাঙা টেবিল, দুটো চেয়ার, নড়বড়ে বেঞ্চ। আছে চার হাজার বই। তবে,
অর্ধেকেরও
বেশি
উই-এ খেয়েছে। এমনই বেহাল পূর্ব মেদিনীপুরের সুজালপুর প্রগতি সঙ্ঘ
পাঠাগার।
ভগ্নপ্রায় ঘরে বসে
গ্রন্থাগারিক সংহিতা বেরা জানান, সদস্য সংখ্যা ১৭৫ থেকে কমতে
কমতে
হয়েছে
৪।
এখনও সদস্য
হিসাবে টিকে থাকা স্থানীয় শিক্ষক তপতী গিরি বলেন, “পাঠাগার
তো নয়,
সাপ-খোপের আস্তানা।
কোনওরকমে বই পাল্টিয়ে পালাই।” তথ্য ও ছবি: সুব্রত গুহ। |
|
কাঁথি ১ ব্লকের রায়পুর পশ্চিমবাড় গ্রাম পঞ্চায়েতের সশানিয়া এসকেইউএস, কাঁথি ৩ ব্লকের লাউদা গ্রাম পঞ্চায়েতের ধাউড়িয়াবাড় পল্লি উন্নয়ন সঙ্ঘ, শেরপুর নবজাগরণ সঙ্ঘ আর করলদা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়এই পাঁচটি সেন্টারে সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে (দুপুর ২টো থেকে সন্ধ্যে ৭টা পর্যন্ত) বিপুল বইয়ের সম্ভার নিয়ে হাজির হয় ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগারের ভ্যান রিকশা। রিকশা চালক বকুল বেরা মাধ্যমিক পাশ। নামমাত্র অর্থে শুধুমাত্র বইকে ভালবেসেই দিনের পর দিন তিনি এই স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে চলেছেন।
এমন পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ায় স্বীকৃতিও মিলেছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন ও কেন্দ্রীয় তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর এই ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার-সহ পূবার্চল জনকল্যাণ সঙ্ঘ গ্রন্থাগারকে গত ২০০৮ সালে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সেরা গ্রামীণ গ্রন্থাগারের স্বীকৃতি দিয়েছে। রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরি ফাউন্ডেশন চেন্নাইতে এক অনুষ্ঠানে গ্রন্থাগারিক দীপক জানার হাতে পুরস্কার তুলে দেন। দীপকবাবুর কথায়, “শুধু পাঠকদের বই সরবরাহই নয়, বই বিমুখ তরুণ প্রজন্মের কাছে বইয়ের প্রতি মুখ ফিরিয়ে দেওয়ার ব্রত নিয়ে গ্রাম-গ্রামান্তরে ছুটে চলেছে বহিত্রকুন্ডা পূর্বাঞ্চল জনকল্যাণ সঙ্ঘের তিন চাকার ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার।”
|
—নিজস্ব চিত্র। |
|
|
|
|
|