উপেক্ষার মাঠে তেকাঠি খুঁজছে মহিলা ফুটবল |
অভিষেক চট্টোপাধ্যায় • কলকাতা |
কলকাতার গুরুদাস কলেজ থেকে বেরিয়ে এক দল ছেলেমেয়ে যখন সিনেমাহল-মুখো, এক দল এখানে সেখানে আড্ডায় মশগুল, সুপ্রিয়া ছোটে মাঠের দিকে।
সল্টলেক থেকে আসে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সুপ্রিয়া দাস। সবুজ মাঠে পায়ে বল না ছোঁয়ানো তাঁর শান্তি নেই। গ্রীষ্ম হোক বা শীত, সকাল-বিকেল নিয়ম করে অনুশীলন তাঁকে করতেই হবে।
কিন্তু সুপ্রিয়ার সঙ্গে বল পেটানোর মতো মেয়ে কই? বাধ্য হয়ে ছেলেদের সঙ্গেই অনুশীলন করতে হয় তাঁকে। ফুটবলই তাঁর প্রথম ভালবাসা। প্রিয় ফুটবলার লিওনেল মেসি। বড় খেলোয়াড় হতে চান। ভাল কোচের সন্ধানেও আছেন, যিনি তাঁকে ময়দান চেনাতে পারবেন।
সুপ্রিয়ার বয়স পেরিয়ে এসেছেন অনেকেই। কেউ-কেউ বিয়ে করেছেন। চাকরিও করেন। তবু ফুটবলের প্রতি ভালবাসায় কলকাতা ময়দানে দাপিয়ে খেলছেন অনেকেই। হাওড়ার বালিতে বাড়ি দীপা বেরার। ১৯৯২ সালে তাঁর ফুটবল জীবন শুরু। চাকরি করেন বিদ্যুৎ দফতরে। আগে মা তাঁর পাশে ছিলেন, এখন স্বামী জানালেন তিনি। তাঁর আবার প্রিয় ফুটবলার কলকাতা ময়দানেরই ব্যারেটো।
বলতে হবে পেশায় স্কুল-শিক্ষিকা পম্পা ঘোষের কথাও। বাড়ি হুগলির শ্রীরামপুরে। চাকরি আসানসোলে। স্কুল থেকে ‘সিএল’ নিয়ে কলকাতা ময়দানে খেলতে আসেন। জীবনের প্রথম কোচ সন্ধ্যা চক্রবর্তীই তাঁর জীবনের প্রেরণা। দীপা, সুপ্রিয়া, শম্পাদের মতো আরও অনেক মহিলা ফুটবলার ছড়িয়ে রয়েছেন রাজ্যে, যাঁরা বলকে কথা বলাতে পারেন। যাঁদের অনেকেরই প্রতিভা প্রথম সারির পুরুষ ফুটবলারদের থেকে কোনও অংশে কম নয়। তবু ব্রাত্য তাঁরা। ব্রাত্য বাংলার মহিলা ফুটবলই। |
বাংলায় আইএফএ পরিচালিত পুরুষ ফুটবলে সমস্ত ডিভিশন মিলিয়ে খেলে ২১০টি দল। সেখানে মহিলা ফুটবলে মাত্র ১৪। পুরুষ ফুটবলে বিদেশ থেকে কোটি টাকার স্ট্রাইকার আসে। মহিলা ফুটবলারদের সর্বোচ্চ দর মেরেকেটে ১৫ হাজার। কেউ বা কিছুই পান না।
রাজ্যে যে ১৪টি মহিলা দল ফুটবল খেলে, তার চারটি হাওড়ার বালি গ্রামাঞ্চল, বিদ্যুৎ স্পোর্টিং, জগৎবল্লভপুর সরোজিনী নাইডু ক্লাব ও রামপুর স্পোর্টিং ক্লাব। বাকিদের মধ্যে জেলার দল বলতে বনগাঁর অখিল ভারতীয় আদিবাসী পরিষদ ও হুগলির মানিক ফুটবল কোচিং সেন্টার। বাকি দলগুলি মোটামুটি কলকাতা শহরকেন্দ্রিক। জেলার মহিলা ফুটবলারেরা জানাচ্ছেন, কিছু দিন আগেও মাঠে নিজেদের খাওয়ার জল বয়ে নিয়ে যেতে হত তাঁদের। অনেক সময়েই মাঠে মেয়েদের শৌচাগার থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের মহিলা ফুটবলও বন্ধ দীর্ঘদিন। বালি গ্রামাঞ্চলের ফুটবলার সুপ্রিয়ার আক্ষেপ, “আসলে আমাদের দেখার কেউ নেই। ভাল খেললেও বাইরে খেলতে যাওয়ার কোনও সুযোগ নেই।”
বালি গ্রামাঞ্চল ক্লাবেরই কর্তা তথা বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য দিলীপ পালের মতে, “১৯৯৩ থেকে আইএফএ মহিলা ফুটবল লিগ পরিচালনা করছে। ১০টা দল দিয়ে শুরু হয়। এখন ১৪। মূলত আর্থিক সমস্যার কারণেই মহিলা ফুটবল ক্লাব বাড়ছে না।” তাঁর আক্ষেপ, “এখনও ভাল টিফিনের লোভ দেখিয়ে গরিব ঘরের মেয়েদের ফুটবলে আনতে হচ্ছে। সরকার মহিলা ফুটবলের দিকে একটু নজর দিক।”
হুগলির ‘মানিক ফুটবল কোচিং সেন্টার’-এর কর্তা মানিক দে বলেন, “আমাদের ক্লাবে ৬০ থেকে ৭০ জন মেয়ে প্র্যাকটিস করে। বেশির ভাগই আদিবাসী পরিবারের। এখনও আমাদের কোনও নিদিষ্ট ঘর নেই। চুঁচুড়া রবীন্দ্রভবনের একটি ঘর অস্থায়ী ভাবে ব্যবহার করি। সেটাও কত দিন পারব জানি না। এই কারণেই সচ্ছল পরিবার থেকে মহিলারা ফুটবলে আসছেন না।”
মোহনবাগানের ফুটবলার দীপেন্দু বিশ্বাসের বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটে। তাঁর নিজের ক্লাব নিউ বাণী সঙ্ঘের মাঠে বেশ কিছু কিশোরী নিয়মিত অনুশীলন করে। তাঁর কথায়, “মেয়েরাও যে ফুটবল খেলে, এটাই তো জানে না গ্রামের লোকেরা। আগে সেই বোধ গড়ে তুলতে হবে। সম্ভব হলে মেয়েদের স্কুলগুলিতে ফুটবলকে বাধ্যতামূলক করতে হবে।”
একই সুর হাওড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার কার্যকরী সভাপতি দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলাতেও। তাঁর মতে, “গোটা ভারতেই অবহেলিত মহিলা ফুটবল। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বাধ্যতামূলক করা না হলে তা কোনও দিন জাতে উঠবে না।”
রাজ্য মহিলা ফুটবলের দায়িত্বপ্রাপ্ত আইএফএ-র সহ-সচিব নিজেই পুরুষ। বাসুদেব রায় নামে সেই কর্তার কথায়, “মহিলা ফুটবলের অবস্থা সত্যিই বেশ খারাপ। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের মত বড় দলগুলি যদি মহিলা দল তৈরি করে তা হলে হয়ত কিছু স্পনসর আসবে।” কিছু দিনের মধ্যে রাজ্যে একটি বড় ও স্কুলস্তরে মহিলা ফুটবল প্রতিযোগিতা শুরুর পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে বলেও তাঁর দাবি।
সিনেমায় মেয়েদের বল পায়ে দৌড় দিতে এখনও তেমন দেখা যায়নি বটে। কিন্তু বর্তমানে কারাবন্দি ইরানি পরিচালক জাফর পানাহির ছবি ‘অফসাইডে’ ফুটবল-প্রেমী এক ঝাঁক তরুণীই ছিলেন নায়িকা। সে দেশে ফুটবল মাঠে মেয়েদের ঢোকা নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও ছেলেদের পোশাকে মুখ ঢেকে যাঁরা স্টেডিয়ামে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করেন এবং ধরাও পড়ে যান।
এখানে বাইরে থেকে তেমন কোনও নিষেধ নেই। তবু কোনও অদৃশ্য তর্জনী মেয়েদের খেলার মাঠের বাইরে রেখে দিয়েছে। কিন্তু কত দিন আর পিছু টেনে রাখা হবে? ওডাফা-চিডি দ্বৈরথ নয়, যুবভারতীতে বল পায়ে মঙ্গলকাব্য লিখছেন ইস্ট-মোহনের বাইশ বঙ্গতনয়া এমন দিন কি সত্যিই আসবে না? |