প্রবন্ধ ১...
ক’টা মেয়ে জমির উত্তরাধিকার পায়
শাশুড়ি মা রোজ এইটুকু ছোট এক বাটিতে মেপে চাল নিতেন বউমাদের জন্য। এক দিন হাত ফসকে বাটি পড়ে ভেঙে গেল। বউমাদের আহ্লাদ দেখে শাশুড়ি বললেন, যতই হাসো বউমা, হাতের আন্দাজ আমার ঠিক আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতের গল্প। পড়ে মনে হয়, এ দেশে মেয়েদের অমনিই দশা। সরকার ঠাকরুন বড় ব্যস্ত ভাবে মেয়েদের পাতে এটা-ওটা চাপাচ্ছেন। ইস্কুলপড়ুয়ার জন্য সাইকেল, আসন্নপ্রসবার জন্য ফ্রি ভ্যান-রিকশা, দু’এক খানা লেডিজ স্পেশাল ট্রেন, অতিশয়-খাটুনি-সামান্য-মাইনের কিছু চাকরি। এ দিকে মেয়েরা দেখছে, আগেও যা পরেও তা। তারা লেখাপড়া শিখছে, রোজগার করছে, ভোটেও জিতছে। অথচ লাথি-ঝ্যাঁটা সহ্য করেও উঠোনের মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হচ্ছে। মেয়েরা পুড়ে মরে, গলায় দড়ি দেয়, তবু কেন ঘর থেকে বেরিয়ে নতুন জীবন খোঁজার সাহস পায় না?
কারণ মেয়েদের হক যা-ই হোক, আসলে কতটুকু তারা পাবে তার মাপ ঠিক করে রেখেছে সরকার, সমাজ। তাই মেয়েদের শিক্ষা, খাদ্য, রেশন কার্ডে নাম আগে লেখানো, এমন নানা নিত্যি-নতুন অধিকার নিয়ে প্রচারের ধুম চলছে। কিন্তু বাবার চাষের জমি পাওয়ার অধিকার যে মেয়েদের তৈরি হয়ে রয়েছে আজ প্রায় আট বছর, তা নিয়ে টুঁ শব্দটি শোনা যায় না।
সংশোধিত হিন্দু উত্তরাধিকার আইন (২০০৫) পুরুষ-মহিলার মধ্যে কোনও তফাতই করে না। বসতবাড়ির অধিকারে, কৃষিজমির অধিকারে, পুরুষ-মহিলার কোনও তফাত নেই। সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারাতে এই আইন যদি মানা হত, তা হলে ভাতের পাতে-মাথার ছাতে সত্যি হয়ে উঠত এই কথাটা যে, ছেলে-মেয়ে সমান। তাই এ আইন সহজে পাশ করানো যায়নি। প্রাক্তন আইএএস, জাতীয় উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য নরেশ চন্দ্র সাকসেনা গল্প বললেন, উত্তরপ্রদেশের ভূমি রাজস্ব মন্ত্রীকে যখন এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন, “তিনি বলেছিলেন, তুমি বরং জমি মালিকানার ঊর্ধ্বসীমা কমিয়ে দলিতদের বেশি করে জমি দিয়ে দাও। পরে দিল্লিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আই কে গুজরালকে বললাম। তিনি বললেন, জাঠ ভোটাররা তো এটা পছন্দ করবে না।”
শেষে আইন পাশ হল, কিন্তু রয়ে গেল খাতায়-কলমে। তা কার্যকর করার জন্য আজ অবধি কেন্দ্র থেকে রাজ্যগুলোর কাছে কোনও নির্দিষ্ট নির্দেশ যায়নি। এবং একটি রাজ্যও এ বিষয়ে প্রশাসনিক নির্দেশ পাঠায়নি জেলা বা ব্লক স্তরের ভূমি রাজস্ব আধিকারিকদের কাছে, জানালেন অশোক সরকার। জমি নীতি নিয়ে কর্মরত একটি সংস্থার প্রতিনিধি তিনি। “যাঁরা বাবার কৃষিজমির ভাগ চেয়েছেন, এমন ১২০ জন মহিলাকে নিয়ে একটি সমীক্ষার কথা ভেবেছিলাম আমরা। বিহার, মধ্যপ্রদেশ এবং অন্ধ্রপ্রদেশ, তিনটি রাজ্যে বহু খোঁজ করেও অতজন পাওয়া গেল না,” বললেন অশোকবাবু। পশ্চিমবঙ্গের এক জেলার ভূমি রাজস্ব আধিকারিক বলেন, “নির্দেশ এসেছে, আমরা যেন ওই আইন মেনে চলি। আইনের কোনও প্রচার হয়নি। কৃষিজমির ভাগ চেয়ে মেয়েদের কোনও আবেদন-অভিযোগও চোখে পড়েনি।”


উত্তরাধিকার: মেয়েরা কে কোথায় দাঁড়িয়ে
হিন্দু উত্তরাধিকার সংশোধন আইন, ২০০৫ মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়া), ১৯৩৭
• বাবার বসতবাড়ি ব্যবহার,
বিভাজন, বিক্রি করার অধিকার
• জন্মসূত্রে কৃষিজমির মালিকানা। কৃষিজমি সহ
অন্যান্য সম্পত্তি বিভাজন, বিক্রি করার অধিকার।
• স্বামীর সম্পত্তিতে বিধবা স্ত্রী, পুত্র ও
কন্যাদের সমান ভাগ।
• বিধবা মহিলারা পুনরায় বিবাহ করলেও
স্বামীর জমি-সম্পত্তির অধিকার পাবেন।
• সম্পত্তির অধিকার রয়েছে স্ত্রী-কন্যার,
যদিও অংশ পুরুষ উত্তরাধিকারীদের চাইতে কম।
• দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে
কৃষিজমিতেও মেয়েদের অধিকার স্বীকার
করা হয়। অন্য নানা রাজ্যে নানা রীতি।
ভারতীয় উত্তরাধিকার আইন, ১৯২৫
• বাবার সব সম্পত্তিতে স্ত্রী-পুত্র-কন্যার সমান অধিকার।

মেয়েদের জমি দিতে যে রাজ্যে এত অনিচ্ছা, সে রাজ্যে জমি বিক্রির একটা প্রধান ‘কারণ’ কিন্তু মেয়েরাই। এই রাজ্যেরই পাঁচটি জেলায় (পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, বীরভূম, দক্ষিণ দিনাজপুর ও বর্ধমান) একটি সমীক্ষায় (২০০০-০২) জমির মালিকদের প্রশ্ন করা হয়েছিল, কী কী কারণে তাঁরা জমি বিক্রি করেন। দেখা গিয়েছিল, প্রধান কারণ (৫০%) হল কন্যাপণ। তার পর অসুখ বা অন্য কোনও দুর্ঘটনার খরচ, অকৃষি কোনও রোজগারের সুযোগ পাওয়া, আর বাসস্থান পরিবর্তন। জমির পরিমাণ অনুসারে পণের অঙ্ক ঠিক হয় (গড়ে এক একরে ৩৩ হাজার টাকা, পাঁচ একরে ৬৪ হাজার টাকা)। এক চাষি গবেষকদের বলেছিলেন, “দু’বিঘে জমি মানে মেয়ের সারা জীবনের সুখ।” তাজ্জবের কথা এটাই যে, মেয়ের সুখের ব্যবস্থা করতে জমি বেচে জামাইয়ের হাতে টাকা তুলে দেন বাপ, কিন্তু মেয়ের নামে জমি লিখে দেন না। যে দেশে পণের জন্য এত বধূহত্যা, সে দেশেও!
মেয়েদের জমির মালিকানা দেওয়ার কথা শুনলেই অন্য যে কথাটা খুব জোর গলায় বলা হয় তা হল: বরের জমি-বাড়ি তো পাচ্ছেই, আবার বাপের জমি-বাড়িতে ভাগ কেন? তার সহজ উত্তর, কেন নয়? ছেলেরা যদি বাপের সম্পত্তি পেয়েও শ্বশুরের থেকে পণ নিতে পারে, মেয়েরাই বা দু-তরফ থেকে প্রাপ্য পাবে না কেন? কিন্তু যুক্তি আরও রয়েছে। প্রথমত, শ্বশুরবাড়ির জমি-বাড়ি থাকলেও তার মালিকানা গ্রামের অধিকাংশ মেয়ে-বউদেরই থাকে না। এমনকী যৌথ পাট্টা পেয়ে থাকলেও বহু মেয়ে তার মালিকানার কথা জানেই না। স্বামীরা জানায় না স্ত্রীদের। দ্বিতীয়ত, নির্যাতন বা অন্য কারণে ঘর থেকে বেরিয়ে এলে স্বামীর সম্পত্তিতে অংশ দাবি করার কোনও সুযোগ মেয়েদের থাকে না।
আরও একটি যুক্তি শোনা যাচ্ছে। ‘লাঙল যার জমি তার,’ এই দাবিতে ভূমি সংস্কার আন্দোলন হয়েছিল। আজ ‘শ্রম যার জমি তার’ এই যদি নীতি হয় তা হলে দ্রুত বাড়াতে হবে মেয়েদের জমির মালিকানা। কারণ কৃষি ক্রমশ হয়ে উঠছে মেয়েদের কাজের জায়গা। জনগণনায়, জাতীয় নমুনা সমীক্ষাতে (২০০৬) দেখা যাচ্ছে, পুরুষ কর্মীদের মধ্যে কৃষি কর্মীর সংখ্যা কমছে, কিন্তু মহিলা কৃষি কর্মীর সংখ্যা বাড়ছে। মানে, কৃষির চাইতে আরও লাভজনক কাজ করতে পুরুষরা বাইরে চলে যাচ্ছেন বেশি, খেত সামলাচ্ছেন মেয়েরা। আজ প্রতি পাঁচটি গ্রামীণ পরিবারের একটিতে মহিলাই ‘কর্তা’। অথচ মেয়েদের নামে জমি নেই বলে তাদের ‘কৃষক’ বলে স্বীকৃতি নেই। কিষাণ ক্রেডিট কার্ড নেই বলে তারা ঋণ পায় না, কৃষি সমবায়ের সদস্য হতে পারে না। কী ফসল চাষ হবে, কোথায় তা বিক্রি হবে, তা নিয়ে কথাই বলতে পারে না মেয়েরা। নরেশ সাকসেনার মতে, এ এক নতুন জমিদারি। পুরুষরা থাকছে বাইরে, আর খেটে মরছে মেয়েরা, যাদের কোনও অধিকারই নেই জমিতে।
সত্যি কি খুব সুবিধে হবে মেয়েদের, যদি তারা জমির মালিকানা পায়? কৃষি ক্রমশ অলাভজনক হয়ে পড়ছে। নির্মাণ, পর্যটন, পরিষেবা এখন লাভজনক কর্মক্ষেত্র। এগুলোর বাইরে, অনিশ্চিত, সামান্য আয়ের কৃষিতে বাঁধা পড়া কি মেয়েদের পক্ষে ভাল? মেয়েদের মালিকানার পক্ষে যাঁরা সওয়াল করেন, তাঁরা বলছেন যে জমিটা আবশ্যক শর্ত। জমি পেলে মেয়েরা কৃষি ঋণ, কৃষি প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ পেতে পারে। তার ফলে যে জমির উৎপাদনশীলতা বাড়ে, এমন নিদর্শন নানা দেশে মিলেছে। আর সামগ্রিক ভাবে এটা প্রমাণিত যে, যে কোনও সম্পদের মালিকানা মেয়েদের হাতে এলে মেয়েদের তো বাড়তি রোজগার, বাড়তি সম্মান মেলেই, সন্তানদেরও ভাল থাকার সম্ভাবনা বেশি। পুরুষরা নেশা-আমোদে পয়সা খরচ করে বেশি, মেয়েরা রোজগারের পাইপয়সা খরচ করে সংসারে। তাই মেয়েদের সম্মান, গরিবের উন্নয়ন, এ দুটোরই পথ বলে দেখা হচ্ছে মেয়েদের জমির মালিকানাকে।
কিন্তু মেয়েরা কী বলছে?
গল্পের ভিতরের গল্পটা রয়েছে সেখানেই। গবেষকরা দেখছেন, অধিকাংশ পরিবারে মেয়েরা তাদের উত্তরাধিকার হিসেবে কী প্রাপ্য তা তো জানেই না (বিহার-অন্ধ্রপ্রদেশে মাত্র ১২% মেয়ে জানে, তারা বাবার জমি পেতে পারে)। উপরন্তু ৪২% বিবাহিত মেয়ে বলেছে, “আমি স্বামীর জমি চাই না।” কেন? “পরিবার-পড়শির সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে চাই না।” কন্যারা অধিকাংশ বলেছে, “বাবার জমি চাই না।” কেন? “স্বামীই দেখবে। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হবে। গ্রামে নিন্দে হবে।” প্রাক্তন ভূমি রাজস্ব মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লাও বলেন, “আইন আছে জেনেও বহু মেয়ে সম্পত্তি দাবি করে না। বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাদের সংস্কার।”
শুনে মনে পড়ে যায় তিন বউয়ের গল্প। সংসারের সকলে তাদের দুচ্ছাই করে। তাই মনের দুঃখে এক দিন ঠিক করল, কাল গোয়াল ঘরে গলায় দড়ি দেবে। পর দিন তিন বউ জড়ো গোয়ালে, কিন্তু কারও সাহস হচ্ছে না এগোনোর। শেষে বড় বউ বলল, ‘‘ওরে আজ যে মঙ্গলবার। আজ গলায় দড়ি দিলে সংসারের অমঙ্গল হয়, জানিস না?”
যারা পায়ের তলার জমিটুকুও দিতে রাজি নয়, তাদেরই আঁকড়ে বেঁচে থাকতে হয় মেয়েদের।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.