মার্কিন বিদেশ সচিব হিসেবে কাজ শুরু করার প্রথম সপ্তাহেই আমার সৌভাগ্য হয়েছিল মায়ানমারের সাহসিনী মহিলাদের একটি দলের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার। সেই দলে দু’জন ছিলেন এককালের প্রাক্তন রাজনৈতিক বন্দি। জীবনে বহু প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছেন, তবু দেখেছিলাম তাঁদের প্রত্যেকের মধ্যেই একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। কমবয়সি মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো, প্রশিক্ষণ দেওয়া, বেকারদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করা এবং সমাজে তাঁদের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করার ব্যাপারে তাঁরা প্রত্যেকেই দৃঢ়সংকল্প। আমি নিঃসংশয়, সমাজ এবং দেশের প্রগতিতে এঁরাই হবেন দিশারি।
মহিলাদের অধিকারগুলিকে সুরক্ষিত রাখতে এবং এগিয়ে নিয়ে যেতে বিভিন্ন সরকার, সংগঠন এবং ব্যক্তিমানুষের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়া জুড়ে যে কাজ করে চলেছে, তার গুরুত্ব কতখানি এঁদের দৃষ্টান্তই তা মনে করিয়ে দেয়। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের মতে, যে সব দেশে নারী-পুরুষের সমানাধিকার স্বীকৃত, তারা অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় অনেক বেশি এগিয়ে থাকে সেই সব দেশের তুলনায়, যেখানে রয়েছে লিঙ্গ-বৈষম্য। রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্য ও কৃষি সংগঠন হিসেব করে দেখিয়েছে যে, মহিলা কৃষিজীবীরা যদি ঠিক পুরুষদের মতো একই ভাবে বীজ, সার এবং কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারতেন, তা হলে পৃথিবীর অপুষ্ট মানুষের সংখ্যা তাঁরা ১০ থেকে ১৫ কোটি কমিয়ে ফেলতে পারতেন।
তবু আজও বহু সমাজ এবং অজস্র পরিবারে মেয়েদের প্রাপ্য মূল্য দেওয়া হয় না, এখনও তারা স্কুলে যাওয়ার সুযোগে বঞ্চিত, এখনও তাদের বাল্যবিবাহে বাধ্য করা হয়। লিঙ্গ-বৈষম্যনির্ভর হিংসায় চিরজীবনের মতো স্তব্ধ কিংবা বিকৃত বিকল হয়ে গেছে বহু জীবন। ২৩ বছর বয়সি যে ডাক্তারির ছাত্রীটিকে নয়াদিল্লিতে বাসে হত্যা করা হল, তার বাবা-মা যে কী যন্ত্রণা পেয়েছেন, দু’টি কন্যার পিতা হিসেবে আমি তা কল্পনাও করতে পারি না। ভাবতে পারি না, কী কষ্ট পেয়েছেন মালালা ইউসুফজাই নামে সেই পাকিস্তানি বালিকাটির বাবা-মা। তা সত্ত্বেও মালালার এই নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকার দৃঢ়তা আমাকে উদ্দীপ্ত করেছে। মৃত্যুপথযাত্রী ‘নির্ভয়া’ যে জোরের সঙ্গে হত্যাকারীদের উচিত বিচার চেয়ে গেছে, তা আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। |
অর্ধেক দেশবাসীকে পিছনে ফেলে রেখে কোনও দেশই এগিয়ে যেতে পারে না। সেই জন্যই আমরা সারা বিশ্বে মেয়েদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে, মহিলা কৃষিজীবীদের শক্তি জোগাতে এবং লিঙ্গ-বৈষম্যজনিত হিংসা বন্ধ করতে সহযোগীদের সঙ্গে কাজ করে চলেছি। সর্বত্রই মার্কিন কূটনীতিকরা শান্তি আলোচনা এবং নিরাপত্তা প্রয়াসে মহিলাদের যুক্ত রাখার চেষ্টা করেন। এ সব ক্ষেত্রে মহিলাদের অভিজ্ঞতা, ভাবনা এবং অন্তর্দৃষ্টির সাহায্য নিতে পারলে ভবিষ্যতে বহু বিবাদ এড়ানো যাবে, শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হবে। সারা পৃথিবীতে মহিলা ও বালিকাদের জন্য বিনিয়োগও মার্কিন বিদেশ নীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। মহিলা উদ্যোগীদের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেবার ক্ষেত্রে আমরা বিনিয়োগ করি। নারী-শিক্ষায় আমরা যে বিনিয়োগ করি, সেটা মূলত জবরদস্তির বাল্যবিবাহ থেকে তাদের সরে আসতে সাহায্য করা, যাতে তারা দারিদ্রের চক্রব্যূহ ছেড়ে বেরোতে পারে, গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিতে পারে এবং সুনাগরিক হয়ে উঠতে পারে।
কাল বিশ্ব নারী দিবস। আমাদের অঙ্গীকার করতে হবে, অসাম্য, বিশ্বের সমস্ত কোণে অগ্রগতিকে থমকে দিচ্ছে, তার অবসান আমরা করবই। এই শপথ আমাদের নিতেই হবে, যাতে আমাদের কন্যারা নির্ভয়ে বাসে করে স্কুলে যেতে পারে, আমাদের বোনেরা তাদের বিপুল সম্ভাবনা পূরণ করতে পারে এবং প্রতিটি নারী ও বালিকা তার মধ্যে নিহিত শক্তির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারে। |