স্মরণ...
উগো চাভেস
(১৯৫৪-২০১৩)
ভেনেজুয়েলার পশ্চিমে বারিনাস প্রদেশে উগো চাভেসের জন্ম ১৯৫৪ সালের ২৮ জুলাই। বাবা-মা প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। ছয় ভাই, উগো মেজ। সংসার চালাতে হিমশিম বাবা-মা উগো ও তাঁর দাদা আদানকে ঠাকুমার কাছে পাঠিয়ে দেন। সেখানেই ১৭ বছর বয়সে দেশের সামরিক অকাদেমিতে নাম লেখান উগো। এবং দ্রুত উঠতে থাকেন। সেনাবাহিনীর গেরিলা-দমন ইউনিটের সদস্য হয়ে দায়িত্ব পান মাওবাদী গোষ্ঠী ‘রেড ফ্ল্যাগ’কে ধ্বংস করার। গেরিলাদের প্রতি রাষ্ট্রের নির্মম আচরণ ক্রমে তাঁকে ক্ষুব্ধ, বিদ্রোহী করে তোলে। তখন তিনি জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার। সহমর্মী অফিসারদের নিয়ে উগো গড়ে তুললেন গোপন সংগঠন, বামপন্থী গেরিলা নেতা ডগলাস ব্রাভোর প্রেরণায়। সেটা সত্তরের দশকের শেষ দিক। লাতিন আমেরিকার উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনের ঐতিহাসিক নায়ক সাইমন বলিভার-এর নাম অনুসরণ করে শুরু হল বলিভারীয় আন্দোলন।
উনিশ শতকে বলিভার সমগ্র লাতিন আমেরিকাকে স্প্যানিশ কঙ্কুইস্তাদরদের ঔপনিবেশিক দখল থেকে মুক্ত করতে যে মহাকাব্যিক সমরাভিযান চালিয়েছিলেন, কলম্বিয়ার ঔপন্যাসিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর ‘দ্য জেনারেল ইন্ দ্য ল্যাবরিন্থ’-এ তার সবিস্তার আখ্যায়িকা লিপিবদ্ধ। উগো চাভেসের সামনে অতএব প্রেরণার অভাব ছিল না।
অনেকের মতে লিবিয়ার কর্নেল মুয়াম্মার গদ্দাফির তিন খণ্ডে রচিত ‘গ্রিন বুক’ও চাভেসকে প্রভাবিত করেছিল। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর চাভেস গদ্দাফির (ও অন্য যাঁরা তৈলসম্পদ কাজে লাগিয়ে ‘জাতীয়তাবাদী সরকার’ গড়েছিলেন, তাঁদের) সঙ্গে কূটনৈতিক ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন। এই সবের মিলিত প্রভাবেই তৈরি হয় চাভেসের নিজস্ব জাতীয়তাবাদী অবস্থান। তবু গোটা আশির দশক জুড়ে চাভেস ও তাঁর সহযোগীরা সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকেন। ব্যাপক দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়ম, আর্থিক সঙ্কট ও নৈরাজ্য ভেনেজুয়েলার মানুষের ক্ষোভ বাড়িয়ে তোলে। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বাড়ার পাশাপাশি মধ্য শ্রেণি ও ব্যবসায়ীরাও সরকারবিরোধী হয়ে ওঠে। ১৯৯২-এর ফেব্রুয়ারি নাগাদ চাভেস ও তাঁর সেনা-অফিসারদের মনে হল, এ বার আঘাত হানা যায়। অভ্যুত্থান দেশের কিছু স্থানে সফল হলেও রাজধানী কারাকাস তাঁরা দখল করতে পারলেন না। অতঃপর চাভেসের আত্মসমর্পণ, কোর্ট-মার্শাল, কারাবাস। দু’বছর পরেই প্রেসিডেন্ট রাফায়েল কালদেরা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালন করে অনেকের সঙ্গে চাভেসকে মুক্তি দেন। জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর চাভেস একশো দিন ধরে সারা দেশে সফর করেন, গড়ে তুললেন তাঁর রাজনৈতিক সংগঠন ‘ফিফ্থ রিপাবলিক মুভমেন্ট’। ১৯৯৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অনায়াসে জিতলেন।
এবং অচিরেই দেশের বিপুল তৈলসম্পদের জাতীয়করণ এক্সন ও অন্যান্য মার্কিন কর্পোরেশনের হাত থেকে ডজন-ডজন তৈলক্ষেত্র ও অন্যান্য জাতীয় সম্পদ কেড়ে নিলেন চাভেস। পরম মিত্র এবং রাজনৈতিক গুরু ফিদেল কাস্ত্রো কিউবায় যা করতে চেষ্টা করেছিলেন, চাভেস সেই পথেই হাঁটতে চাইলেন। মার্কিন আধিপত্যের পাল্টা জ্বালানি রফতানিকারী দেশ ইকুয়েডর ও বলিভিয়াকে নিয়ে একটি বলিভারীয় জোট গড়লেন, কিউবা ও নিকারাগুয়ার মতো দেশের অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চার করলেন। চাভেসের পশ্চিম-বিরোধী বিদেশনীতি এবং দেশের ভিতর সরকারি ভর্তুকি-নির্ভর উন্নয়ন কর্মসূচি তাঁকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষত বুশ প্রশাসনের চক্ষুশূল করে তোলে, স্বদেশের বিত্তশালী সম্প্রদায়, মধ্য শ্রেণি ও বৃত্তিজীবীরা তাঁর মুণ্ডপাত শুরু করে। রুষ্ট এবং সন্ত্রস্ত লগ্নিকারীরা একে-একে দেশ ছাড়তে শুরু করেন। বহু বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, ছোট ব্যবসায়ী দেশান্তরী হন। তাঁদের জায়গা ভরাট করতে থাকেন হাইতি, চিন ও লেবাননের মতো দেশ থেকে অভিবাসী অসংখ্য লোক।
নিজে যোদ্ধা হলেও এবং এক বার সামরিক অভ্যুত্থানের ব্যর্থ চেষ্টা সত্ত্বেও চাভেস সরাসরি বন্দুকের সঙিন উঁচিয়ে ভেনেজুয়েলার ক্ষমতা দখল করেননি। ১৯৯৮ সালে নির্বাচনে জিতেই তিনি প্রেসিডেন্ট হন। তাঁর ১৪ বছরের শাসনকালে প্রতিটি নির্বাচনেই তাঁর সাফল্য বিপুল। সেই নির্বাচন কতটা অবাধ ও নিরপেক্ষ, তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল, কিন্তু এটা নিতান্ত স্পষ্ট যে, দারিদ্রমুখী বিভিন্ন কর্মসূচি এবং প্রান্তিক মানুষদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের জন্য গৃহীত রকমারি প্রকল্প নিম্নবর্গীয়দের কাছে তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়। তাঁর অসুস্থতার সংবাদেই যে উদ্বিগ্ন জনতা কারাকাসের রাস্তায় ভিড় জমাত, তাতে সেই জনপ্রিয়তার প্রমাণ মেলে। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ অপ্রত্যাশিত না হলেও দেশে যে শোকের আবহ রচনা করে, তা চমকপ্রদ।
চমকপ্রদ এই জন্য যে, নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হয়েও চাভেস উত্তরোত্তর স্বৈরাচারী হয়ে উঠছিলেন। নিজের আধিপত্যকে দীর্ঘস্থায়ী করতে তিনি এমনকী তাঁর প্রেসিডেন্ট পদে অনন্ত কাল দাঁড়াবার অধিকার নিয়েও গণভোট অনুষ্ঠান করেন। পর-পর দু’বারের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না, এই সাংবিধানিক বিধান পাল্টে ফেলতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। এ ব্যাপারে তিনি অবশ্য একা নন। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মহেন্দ্র রাজাপক্ষেও নিজের ক্ষমতা স্থায়ী করতে সংসদীয় ভোটে সংবিধানের অনুরূপ সংশোধন ঘটিয়েছেন। আর রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন তো পর-পর দু’বার প্রেসিডেন্ট, তার পর এক বার প্রধানমন্ত্রী, তার পর আবার দু’দফার প্রেসিডেন্ট, এই ভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন। উগো চাভেসের দুর্ভাগ্য, তাঁকে নিয়তি তত দীর্ঘায়ু করেনি, মাত্র ৫৮ বছরেই তাঁকে বিদায় নিতে হল।
কিন্তু এটাও সত্য যে, স্বৈরাচারের প্রবণতা ক্রমশ তাঁর জনপ্রিয়তায় ভাগ বসাচ্ছিল। বিরোধিতা তিনি বরদাস্ত করতে পারতেন না। অপছন্দের লোকদের সেনাবাহিনী থেকে, সরকারি বিভিন্ন পদ থেকে, তেল সংস্থার আধিকারিকের পদ থেকে বরখাস্ত করতেন যখন-তখন। জাতীয় তেল কোম্পানির কর্মীরা ধর্মঘট করলে ২০০২ সালে তিনি ১৯ হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করেন। ২০০৪ সালে এক ডিক্রি জারি করে সুপ্রিম কোর্টের স্বাধিকার খর্ব করে দেন। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলিকে বাধ্য করা হয় দেশবাসীর কাছে তাঁর সাপ্তাহিক রবিবাসরীয় টেলি-ভাষণ সম্প্রচার করতে। কোন সরকারি বাসভবনে তিনি কোন দিন শুতে যাচ্ছেন, তা জানানো হত না, এতটাই ষড়যন্ত্র ও মৃত্যুর ভয় ছিল তাঁর। গণতন্ত্রের পথ ধরে ক্ষমতায় এলেও চাভেসকে ব্রাজিল, চিলি, আর্জেন্তিনার বামঘেঁষা রাষ্ট্রপ্রধানদের মতো ঠিক গণতন্ত্রী বলা যাবে না। গণতন্ত্রকে তিনি তাঁর মতো করে কাজে লাগিয়েছিলেন।
ফিদেল কাস্ত্রো এখনও জীবিত। তাঁর ভাবশিষ্য লাতিন আমেরিকার রাজনৈতিক আকাশ থেকে খসে পড়লেন। মৃত্যুর আগের কয়েকটা বছর কালান্তক ক্যান্সার রোগের সঙ্গে চাভেসের লড়াইটা আগাগোড়া কাস্ত্রোর কিউবাতেই হয়। ক’দিন আগেই ফিরেছিলেন কিউবা থেকে। আবার জনতার সামনে এসে দাঁড়াবেন, ভাবছিলেন তাঁর অনুরাগীরা। কিন্তু ইতিহাস তাঁর জন্য অন্য ছক তৈরি করেছিল। চাভেসের মৃত্যুকে ঠিক গার্সিয়া মার্কেস-রচিত কুলপতির হেমন্তের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। কারণ রাজনৈতিক স্বৈরাচারের অনন্তমেয়াদি হওয়ার যে রূপক তাঁর উপন্যাসে আখ্যায়িত, ভেনেজুয়েলায় তার বাস্তবায়ন এখনও অনিশ্চিত। প্রেসিডেন্ট চাভেসের মৃত্যুর পর তাঁর মনোনীত উত্তরসূরি নিকোলাস মাদুরোকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে ভোটযুদ্ধে জিতে আসতে হবে।
যদি তিনি জিতেও যান, চাভেসের পথে হেঁটে কি তাঁর উত্তরসূরি পারবেন বলিভারীয় বিপ্লব ও লাতিন আমেরিকান মহাজোটের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে? চাভেস যেমন পরিকল্পিত ভাবে নিজের ভাবমূর্তি ও প্রতিমা গড়তে গিয়ে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও রীতিপদ্ধতি বিসর্জন দিয়েছেন, তাতে তাঁর পরবর্তী শূন্যতা কী দিয়ে ভরাট করবেন মাদুরো? চাভেসের ‘বলিভারীয় জোট’ থেকেও কি বেরিয়ে যায়নি বামপন্থী লুলা শাসিত ব্রাজিল? চিন, দক্ষিণ আফ্রিকা, রাশিয়া ও ভারতের মতো দেশের সঙ্গে আলাদা জোটের শরিক হয়ে? শুধু মার্কিন-বিরোধিতার ঠান্ডা-যুদ্ধকালীন রণহুঙ্কার দিয়ে কি একবিংশ শতকের দুনিয়ায় স্বাস্থ্যকর, ফলপ্রসূ বিকল্প গড়ে তোলা যায়? যে প্রতিবেশীদের চাভেস স্বাভাবিক মিত্র মনে করতেন, সেই সব দেশ কিন্তু মুক্ত দুনিয়ার অনুরূপ অবাধ গণতন্ত্রে আস্থা রেখেছে, প্রেসিডেন্টদের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিতে নয়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.