পুরসভা ভোট আসছে। সম্ভবত সে কথা মাথায় রেখেই বর্ধমান পুরসভার ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষের বাজেটে নাগরিক স্বাচ্ছন্দ, গরিব মানুষের সামাজিক উন্নয়ন ও নানা উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়নের উপরে জোর দিল কোণঠাসা বামফ্রন্ট।
বুধবার এই বাজেট পেশ হওয়ার পরেই বিরোধী তৃণমূল কাউন্সিলর রত্না রায় সরাসরি অভিযোগ করেন, এই পুরবাজেট সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টায় তৈরি। তবে পুরপ্রধান তথা সিপিএম নেতা আইনুল হক অবশ্য দাবি করেন, “এই বাজেট মোটেই ভোটমুখী নয়। অন্য বছর আমরা যেমন করে উন্নয়ন করে থাকি, এ বারও সেই দিকেই নজর দেওয়া হয়েছে। তবে একটা কথা বলতে পারি, উন্নয়নের নিরিখে যদি ভোট হয়, তা হলে আমরা মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন পাব।”
পুরপ্রধান জানিয়েছেন, পুর বাজেটে শতকরা ২৫ ভাগ টাকা গরিব, বস্তিবাসী, তফসিলি জাতি ও উপজাতি এবং সংখ্যালঘু মানুষের উন্নয়নের জন্য আলাদা করে রাখা হয়েছে। চলতি বাজেটে নতুন করে চারটি পানীয় জল সরবরাহের পাম্প স্থাপনের কথাও বলা হয়েছে। তৃণমূল কাউন্সিলার নেতা খোকন দাস অবশ্য বলেন, “আমাদের খসড়া বাজেটের কপি দেওয়া হয়নি। তাই আমরা বাজেট অধিবেশন বয়কট করেছি।” বস্তুত, এই অজুহাতেই গত দশ বছর ধরে তৃণমূলের কাউন্সিলরেরা বাজেট অধিবেশন বয়কট করে আসছেন। পুরপ্রধান পাল্টা বলেন, “মঙ্গলবারই বিরোধী দলনেতার কাছে ওই খসড়া পাঠানো হয়েছে। সেটি তাঁর বাড়িতে গ্রহণও করা হয়েছে।” বিরোধী দলনেতা সমীর রায় অসুস্থ ও শহরের বাইরে থাকায় তাঁর প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
পুরসভা সূত্রে বলা হয়েছে, ২০১১-১২ সালে বাজেট ছিল ১০৩ কোটি টাকার। ২০১২-১৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১৬ কোটিতে। চলতি অর্থবর্ষে তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১২১ কোটির বেশি। পুরপ্রধানের অভিযোগ, তাঁরা বাজেট বরাদ্দ বাড়ালেও সরকারি অনুদান ক্রমেই কম পাচ্ছে পুরসভা। ১৯৭৭ সালে যে সরকারি অনুদান ছিল ৮,৪৪,৭৫১ টাকা, ২০০৭-০৮ সালে তা গিয়ে দাঁড়ায় ১৯,৮৫,৯৭,৩২৪ টাকায়। কিন্তু ২০১১-১২ অর্থবর্ষে তা কমে দাঁড়ায় ৯,১০,৬৮,৬৭৮ টাকায়। চলতি ন’মাসে তা দাঁড়িয়েছে ৬,৪৭,৫৮,৩০০ টাকায়। অর্থাৎ, নতুন রাজ্য সরকার ক্ষমতায় এসেই বামফ্রন্ট পরিচালিত বর্ধমান পুরসভাকে ভাতে মারার চেষ্টা করছে, এমনই ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।
পুরপ্রধানের বক্তব্য, “এই পরিস্থিতিতে আমরা নিজেদের আয়বৃদ্ধির চেষ্টা করছি। গত বছরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পুরসভা ৮,৩৩,৬৯,৮৫৩ টাকা আয় করেছে। অর্থবর্ষের শেষে তা গিয়ে দাঁড়াবে ১২ কোটিতে। ২০১৩-১৪ সালে এই আয় ১৫ কোটিতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।” তাঁর দাবি, এক দিকে যেমন সরকারি সাহায্য কমছে, কর্মীর সংখ্যাও কমছে। এক সময়ে পুরকর্মীর সংখ্যা ছিল ১,২২১। এঁদের ১০০ জন আগেই অবসর নিয়েছেন। এ বছর অবসরপ্রাপ্তের সংখ্য্া ৭৬। চাকরিতে বহাল অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে ৯৩ জনের। কিন্তু সরকার নতুন কর্মী দিচ্ছে না। এমনকী অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারিদের পেনশনের টাকা পুরসভাকে নিজেদের তহবিল থেকে মেটাতে হচ্ছে।
গত বিধানসভা নির্বাচনে নিজের শহরে হেরে প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন বর্ধমান উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তাঁর জায়গায় বসেছেন শহরের নতুন তৃণমূল বিধায়ক তথা মন্ত্রী রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। এর পরেই পুরসভার সঙ্গে সঙ্ঘাতে নেমেছে পর্ষদ, অভিযোগ পুরপ্রধানের। তাঁর দাবি, “পানীয় জল দামোদর থেকে তুলে পরিশ্রুত করে শহরে সরবরাহ করতে গত বছর বাজেটে ১০৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে পুরসভা। কিন্তু বর্ধমান উন্নয়ন পর্ষদ এই কাজ পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেলে করতে চেয়ে রাজ্য সরকারকে চিঠি দিয়েছে। পুরসভা তাতে আপত্তি করেছে। কারণ, পুরসভার নিজস্ব ৪৫ বিঘে জায়গায় কোনও বেসরকারি অংশীদারকে নিয়ে প্রকল্প তৈরি করা সম্ভব নয়। এই টানাপোড়েনের জেরে পানীয় জল সরবরাহের মত জরুরি কাজ আটকে গিয়েছে।” বর্ধমান উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান রবিরঞ্জনবাবু অবশ্য বলেছেন, “এত দিনে পুরসভা ওই পানীয় জল প্রকল্পটি গড়তে পারেনি। ভোট এগিয়ে আসছে দেখে ওরা এই নিয়ে নানা গালগল্প ফেঁদেছে। ওরা যদি প্রকল্পটি করতে পারে তো করুক না! আমাদের তরফে কোনও আপত্তি নেই।” |