|
|
|
|
ফলতা পিরামিড কাকাবাবু |
সোজা নীল নদের দেশ। পিরামিড। মুবারক। তাহরির স্কোয়ারের বিপ্লব। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা?
পিরামিডের ধারে বসেই ইন্দ্রনীল রায়ের সঙ্গে অকপট প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় |
কুড়ি বছর আগে ফলতা আর দিঘায় আউটডোর করতেন। আজকে পিরামিডের সামনে শট দিচ্ছেন।
অবাক লাগে জানেন! অসম্ভব ভালও লাগে। স্যাটিসফায়েড লাগে। পিছন ফিরে দেখা আমার অভ্যেসে নেই। তবে এই জার্নিটা ভীষণ রোমাঞ্চকর। শুধু আমার নয়, টলিউডের জন্যও একটা রোমাঞ্চকর জার্নি। এক সময় আমি সান্দাকফুতে আউটডোর করতে চেয়েছিলাম বলে প্রযোজক আঁতকে উঠেছিল। সেখান থেকে সেপ্টেম্বর মাসে আইসল্যান্ড, ডিসেম্বরে নিউ ক্যাসেল। আর এখন তো মিশরে শু্যটিং করলাম। জার্নিটা সত্যিই মনে রাখার মতো। তবে পুরনো অনেক ঘটনা মনে পড়ে।
যেমন?
একটা সময় ছিল যখন নিদারুণ অভাবের মধ্যে দিয়ে আমাদের সংসার চলত। আমার মা স্টুডিয়োতে হিরোইনদের কাছে শাড়ি পর্যন্ত বিক্রি করেছেন। মনে পড়ে মহুয়া রায়চৌধুরীর কথা। একদিন স্টুডিয়োতে শাড়ি বিক্রি করতে দেখে উনি মাকে ডাকলেন নিজের ঘরে। কোনও কিছু না দেখে সব শাড়ি কিনে নিয়েছিলেন সে দিন। আজকে বিদেশে ভ্যানিটি ভ্যানে বসে থাকতে থাকতে, বিদেশি ক্রু-র সঙ্গে শ্যুটিং করছি দেখলে সেই সব দিন বড্ড মনে পড়ে। এ সবের মাঝে আর একটা জিনিসও তো টালিগঞ্জে শুরু করে দিলাম চুপচাপ...
কী সেটা?
এই যে আপনি কলকাতার মিডিয়া থেকে এখানে এসেছেন, এটাও তো একটা গ্রোথ! মুম্বইতে কী দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রিতে মিডিয়াকে নিয়ে যাওয়ার চল অনেক দিন আগে থেকেই রয়েছে। টলিউডেও শুরু করে দিলাম সেটা। অবশ্যই প্রযোজকরা আমার পাশে ছিলেন বলেই সম্ভব হল।
প্রায় দু’সপ্তাহ তো শ্যুটিং করলেন। কেমন হল শ্যুটিং?
অসম্ভব হেক্টিক। প্রথম কয়েক দিন মরুভূমিতে শু্যটিং ছিল। সকালবেলা শ্যুটিং স্পটে পৌঁছনোর পর এক বারও বসার অবকাশ পাইনি। দুপুরে কোনও মতে লাঞ্চ। সৃজিত, সৌমিক, স্বস্তিকা, নীল আমরা অসম্ভব খেটেছি। সারা দিনের পর হোটেলে ফিরে শরীরে আর কিছু থাকত না। তার মধ্যে এই ধুলো!
পিরামিডের ভিতরেও না কি ‘কাকাবাবু’ শু্যটিং করেছেন?
(হেসে) এটা কী করে করেছি সেটা সৃজিত আর সৌমিক আরও ভাল বলতে পারবে। এমনিতে পিরামিডের ভিতরে ঢুকে শ্যুটিং করার অনুমতি পাওয়া যায় না। কিন্তু হয়ে গিয়েছে শ্যুটিংটা (হেসে)। বুঝতে পারছেন কী করে হল? ক্যানন ফাইভ ডি ক্যামেরা নিয়ে একেবারে সিন শ্যুট করে এলাম। স্ফিংস-এর মন্দিরেও শু্যট করা বারণ। ওখানেও তো আমরা একটা লম্বা শ্যুট করলাম। ‘মিশর রহস্য’ মুক্তি পাওয়ার সময় সিনটা দেখে আপনাদের ভাল লাগবে। ও রকম দৃশ্য বাংলা ছবিতে দর্শক আগে দেখেননি। |
|
তাহরির স্কোয়ারে প্রসেনজিৎ |
শ্যুটিংয়েও তো অনেক ঝামেলা হয়েছে?
হ্যাঁ হয়েছিল। স্থানীয় মিশরীয় ক্রু-দের মধ্যে তিন চার জন ছাড়া কেউ ইংরেজি ভাষাটা বোঝে না। তার মধ্যে তিন দিন তো মারামারিই হল।
মারামারি হল! কার সঙ্গে?
স্থানীয় মিশরীয় ক্রু-রা নিজেরাই নিজেদের সঙ্গে মারামারি করল। লোকগুলো বড্ড আবেগপ্রবণ। হাইপার। কথা নেই বার্তা নেই, রেগে যায়। সাধারণ সময়ে ওরা যে ভাবে কথা বলে আপনি বুঝতেই পারবেন না ওরা রেগে আছে কি না! উফ্, সে এক অভিজ্ঞতা! বিপ্লবের পরে তো পুরো দেশটা ফুটছে। মেহমুদ বলে এক মিশরীয় অভিনেতা আমার সঙ্গে কাজ করছেন। তাঁর কাছে বিপ্লবের গল্প শুনছিলাম।
কী শুনলেন?
শুনলাম ফেসবুক আর ট্যুইটারে হোসনি মুবারককে নিয়ে অনেক দিন ধরেই ক্ষোভ চলছিল। একটি ছাত্র মুবারককে সরানোর জন্য ফেসবুকে একটা পোস্ট করে। পরের দিন সকালে ওই ছাত্রকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। মেহমুদরা বলছিলেন ছাত্রের মৃত্যুটা ঢাকতে তার মুখে কোকেন গুঁজে দেওয়া হয়, যাতে মনে হয় মাত্রাতিরিক্ত ড্রাগ নেওয়ার ফলেই মৃত্যু হয়েছে তার। এতে ছাত্ররা প্রচণ্ড রেগে যায়। তাদের মধ্যে ৭২ জন গুলিতে প্রাণ হারায়। এটা ছিল বিপ্লবের প্রথম দিন।
তার পর?
তার পর দিন থেকে না কি পুরো কায়রো, এবং ধীরে ধীরে গোটা মিশরটাই রাস্তায় নেমে আসে। রাস্তায় লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখে পুলিশ পিছু হটতে বাধ্য হয়। এবং সবার মুখে নাকি একটাই স্লোগান ছিল। ‘লিভ’। তার পর দিন তো মুবারক সরে যেতে বাধ্য হন।
তাহরির স্কোয়ার গিয়েছেন তো?
হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। ওখানে গাড়ি নিয়ে যাওয়া বারণ। তাই পায়ে হেঁটে গিয়েছিলাম। এখনও পোস্টার পড়ে রয়েছে। তবে মেহমুদ বলছিলেন বিপ্লবটা একটু দিগ্ভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছে। বাড়িওয়ালার সঙ্গে ঝামেলা হলেও নাকি লোকে তাহরির স্কোয়ার চলে যাচ্ছে আজকাল। পুরো ব্যাপারটা চোখের সামনে দেখা সত্যিই এক উত্তেজক অভিজ্ঞতা। সাধারণ মানুষ রেগে গেলে কী হয় সেটা মিশরে না এলে বুঝতে পারতাম না।
কায়রো ঘুরেছেন তা হলে খুব?
শেষ দু’দিন আমার একটু হালকা কাজ ছিল। ওই দু’দিনই বেরিয়েছিলাম ঘুরতে। আর তা ছাড়া বেরোব কী করে! সৃজিত ছুটি দিলে তো বেরোব...
কেমন শ্যুট করলেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়?
খুব ভাল শ্যুট করল। সৃজিত আর সৌমিকের টিউনিংটা দারুণ। তবে সৃজিত বড্ড বেশি শট নেয়। ওটা ওকে একটু কমাতে হবে। আমার কিছু পাসিং শট ছিল কায়রো শহরে। যে পরিমাণ শ্যুট করেছে, একটা আস্ত তিন ঘণ্টার ডকুমেন্টারি করে নিতে পারবে ও। |
|
স্ফিংসের সামনে ‘মিশর রহস্য’-এর শ্যুটিং। স্পটে হাজির প্রসেনজিৎ, আরিয়ান এবং সৃজিত |
এর আগে এসেছিলেন মিশরে?
না। এই প্রথম এলাম কায়রো। নীল নদের ধারে শহরের একটা অংশ অসম্ভব ভাল। সেখানে ম্যারিয়ট, ইন্টারকন্টিনেন্টাল, ফোর সিজনস হোটেল, সবই রয়েছে। কিন্তু নদী পেরিয়ে গিজা পৌঁছলেই পুরো দৃশ্যটা উলটো। অসম্ভব নোংরা একটা শহর। আমার কিন্তু একটা সময়ের পর খুব একঘেয়ে লেগেছে। আউটডোরে এসে আমি শ্যুটিং-এর পর হোটেলে বসে থাকা লোক নই। কিন্তু কায়রোতে কোনও উপায় ছিল না। হোটেলও বদলালাম শ্যুটিংয়ের মাঝে।
হোটেল বদলালেন কেন?
প্রথম দিকে ‘লা মেরিডিয়ন’-এ ছিলাম। ওখান থেকে সরাসরি পিরামিড দেখা যায়। কিন্তু সেখান থেকে আমার মেক আপ ম্যান আর বাকিদের আসতে যেতেই দেড় ঘণ্টা লেগে যেত। তার উপর কথা বলার কেউ নেই। আমি তো বাধ্য হয়েই বাকিরা যে হোটেলে উঠেছে, সেই হোটেলে শিফ্ট করলাম। ওখানে তবু কিছু মানুষ তো ছিল, যাদের সঙ্গে কথা বলা যায়। টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে আড্ডা হত মাঝে মধ্যে। ওদের এক দিন খাইয়েছিলাম। শপিং করার ব্যবস্থা করলাম ওদের। আমাকে স্বস্তিকা একটা ভাল কথা বলেছে।
কী?
বলেছিল আমার মধ্যে দু’টো মানুষ আছে। একটা হিরো আর অন্য মানুষটা প্রোডাকশন ম্যানেজার। মাঝে মধ্যেই সেই প্রোডাকশন ম্যানেজারটা বেরিয়ে আসে। সবাই খেল কি না, কার কী অসুবিধা, কার কী দরকার আমার এই কাজটা করতে ভাল লাগে। আর হোটেলে ফিরে এসে এটা করা ছাড়া বিশেষ কিছু করারও তো থাকে না।
কী করতেন তা হলে?
কাকাবাবুর চরিত্রের জন্য আমার চুলের কোঁকড়ানো ব্যাপারটা করতে অনেকক্ষণ সময় লাগত। সকাল ছ’টায় কল টাইম মানে মেক আপ-এ বসতাম ভোর চারটেতে। হোটেলে ফিরে তাই মেক আপ আর চুল স্বাভাবিক করতেই দু’ঘণ্টা কেটে যেত। তার পর একটু মিটিং। তার পর খেয়ে ঘুম। টিভিতেও শুধু আরবি চ্যানেল। কিছু দেখারও থাকে না।
কাকাবাবুকে তো অনেকে চিনেও ফেললেন?
হ্যা।ঁ ‘সাংহাই’ দেখেছেন এখানে অনেকেই। ছবি তুলতে আসতেন। ওখানকার লোকজন অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে আমার ছবি দেখেছেন। অনেক কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। শুনলাম পিরামিড চত্বরে অমিতাভ যখন এসেছিলেন, তখন তিন লক্ষ লোক এসেছিলেন ওঁকে দেখতে। এই মানুষগুলোই আলাদা। কত স্টার তো এল গেল, কেউ অমিতাভ বচ্চন হতে পারল না। অমিতজি, সুনীল গাওস্কর এঁরা অন্য গ্রহের মানুষ। আর যে ভাবে নিজেদের ক্যারি করেন তা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।
প্রচুর শপিং করলেন শুনলাম?
হ্যাঁ, অনেক কিছু কিনেছি। অনেককে উপহার দিতে হবে বলে টুকটাক অনেক কিছু কিনে ফেললাম। নিজের জন্য প্রচুর জামাকাপড় কিনলাম। আর নিজেকে একটু ইনডাল্জ করলাম অনেকগুলো কার্পেট কিনে। ও রকম কার্পেট দেখে আর লোভ সামলাতে পারিনি। বাইশটা কার্পেট কিনে ফেলেছি! টাকাপয়সা সব শেষ (হেসে)। ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স কমে গিয়েছে অনেকটা। শপিং করার ফাঁকে একদিন হুকাও খেলাম। সব মিলিয়ে মজা হল খুব।
কাকাবাবুর পর কী?
এই মুহূর্তে কাকাবাবু শেষ করাটাই প্ল্যান। তার পর দু’মাস ভাবব আগামী কী কাজ করা উচিত। কাকাবাবু তো হয়ে গেল, ওটা অতীত। ওটা নিয়ে আর ভাবতে চাই না। এ বার অন্য কিছু খুঁজে বার করতে হবে আমাকে। |
ছবি: ইন্দ্রনীল রায় |
|
|
|
|
|