মারণরোগকে পাত্তা না দিয়েই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে বর্ধমানের কোড়ার গ্রামের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী প্রিয়াঙ্কা সামন্ত। লড়াইটা অনেকটাই যেন ক্রিকেটার যুবরাজ সিংহের মতো। জীবনের ষোলোটা বছর পেরনোর আগেই পা বাদ চলে গিয়েছে প্রিয়াঙ্কার। বাঁচার তাগিদে কেটে ফেলতে হয়েছে বাঁ পা। তবু তার এগিয়ে যাওয়া আটকাতে পারেনি এই মারণরোগ। সোমবারও কৃত্রিম পা লাগিয়ে মাধ্যমিকের অঙ্ক পরীক্ষায় বসেছে সে। টেস্টেও উত্তীর্ণ হয়েছে প্রথম বিভাগে।
২০১১ সালের সরস্বতী পুজোর দিন। কোড়ার রাধাকিশোর উচ্চবিদ্যালয়ে পূজোর তোড়জোড় করার সময়েই আঘাত লাগে তাঁর বাঁ পায়ের। পা ফুলে যায়। স্থানীয় অনেক চিকিৎসককেই দেখানো হয়েছিল। কিন্তু তাতে ব্যাথা বা ফোলা কোনওটাই সারেনি।
অক্টোবরের শেষে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা ক্ষত ও সংক্রমণ দেখে ক্যানসার বলে সন্দেহ করেন। এই দুরারোগ্য অষ্ট্রিওজেনিক সারকোমা বা ওজিএস ক্যানসারে আক্রান্ত বালিকাকে চিকিৎসার জন্য যেতে হয় মুম্বইয়ের বিশেষ হাসপাতালে। সেখানে টানা এক বছর চিকিৎসার পরে কেটে ফেলতে হয় ছাত্রীটির বাঁ-পায়ের প্রায় পুরোটাই। ২০১২ সালের মে মাসে সুস্থ হয়ে ফিরে আসে প্রিয়াঙ্কা। ততদিনে তার কৃত্রিম পা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। তার পর থেকে ফের শুরু পথ চলা। প্রিয়াঙ্কা বলেন, “মুম্বই থেকে ফিরে স্কুলে গিয়ে দেখা করলাম। মাষ্টারমশাইরা বললেন, টেস্ট পরীক্ষাটা দিতে। মাত্র কয়েকদিনের প্রস্তুতি নিয়ে টেস্টে বসে প্রথম বিভাগে নম্বর পাওয়ার পরে ঠিক করলাম, যত কষ্টই হোক না কেন, মাধ্যমিকে বসব।” |
প্রিয়াঙ্কার বাবা সোমনাথ সামন্ত একটি নির্মাণ সংস্থার সামান্য কর্মী। জমি বিক্রি করে সাত লক্ষ টাকা জোগাড় করেছেন মেয়ের চিকিৎসার জন্যে। গোটা পরিবার উদ্যোগী হয়ে প্রিয়াঙ্কাকে সারিয়ে তুলেছে। তবে সোমনাথবাবুর একটাই আক্ষেপ, “এত কষ্ট করে ওকে ভাল করে তুললাম। কোনও শিক্ষক যদি বিনা বেতনে মেয়েটাকে পড়াতে রাজি হতেন, তা’হলে একটু সুবিধা হত।” তবে স্কুলের শিক্ষকদের বক্তব্য, মেয়েটির পরিবারের তরফে তেমন কোনও আবেদন তাঁদের কাছে করা হয়নি। তবে প্রিয়ঙ্কার লড়াইকে সম্মান জানিয়েছেন তাঁরা।
কিন্তু স্কুলের শিক্ষক না থাক, গৃহশিক্ষকের অভাব হয়নি প্রিয়াঙ্কার। গ্রামেরই এক বিএড প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বেকার যুবক চিরদীপ গঙ্গোপাধ্যায় পড়াচ্ছেন প্রিয়াঙ্কাকে। তাঁর কথায়, “ওর এই লড়াই তো বিফলে যেতে পারে না। তাই যতটা সম্ভব সাহায্য করি ওকে।”
কেমন হচ্ছে মাধ্যমিক পরীক্ষা? প্রিয়াঙ্কা বলছেন, “টানা বসে থাকতে কষ্ট হয়। কৃত্তিম পা খুলে বসতে হয়। ফেরার সময়ে ফের সেটাকে পরে নিতে কষ্ট হয়। তবে যা পরীক্ষা দিয়েছি, তাতে প্রথম বিভাগেই পাশ করা উচিত।” বড় হয়ে নিজে শিক্ষক হতে চায় এই মেয়ে। চায় এমন শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধীদের সাহায্য করতে। কবিতা আর সাহিত্য পড়তেই ভালবাসে সে। সুযোগ পেলে ইচ্ছা রয়েছে আবৃত্তিকার হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার। |