সরকারের ভাঁড়ে ভবানী। অথচ কেরানি পদ খালি পড়ে এক লক্ষের বেশি। কাজকর্ম হোঁচট খাচ্ছে প্রতি পদে। এই অবস্থায় প্রায় অর্ধেক বেতনে কেরানি নিয়োগের ব্যবস্থা করল
রাজ্য সরকার।
গত শুক্রবার প্রকাশিত সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এখন থেকে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) ও স্টাফ সিলেকশন কমিশনের (এসএসসি) পরীক্ষা দিয়ে লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক (গ্রুপ-সি) পদে যোগ দেওয়ার যোগ্যতা যাঁরা অর্জন করবেন, প্রাথমিক ভাবে তাঁদের নিয়োগ করা হবে তিন বছরের জন্য অস্থায়ী (প্রোবেশন) ভিত্তিতে। এই তিন বছরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মীকে কর্মদক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। পাশ করতে হবে বিভাগীয় পরীক্ষায়। প্রতি বছর তাঁর কাজের মূল্যায়ন করা হবে। তবেই পাকা হবে চাকরি। তিন বছর প্রোবেশনে থাকাকালীন কোনও কর্মীর কাজ সন্তোষজনক না-হলে তিনি আরও এক বছর সময় চেয়ে আবেদন করতে পারবেন। তার পরেও পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হলে চাকরি চলে যাবে।
কিন্তু এই অস্থায়ী কর্মীরা স্থায়ী পদের পুরো বেতন পাবেন না। এঁদের কেবলমাত্র মূল বেতন (বেসিক পে) এবং গ্রেড পে দেওয়া হবে। বছরে ৩ শতাংশ হারে বেতন বাড়বে। চিকিৎসা ভাতা পেলেও মহার্ঘভাতা (ডিএ), এইচআরএ-সহ অন্য কোনও সুযোগ সুবিধা তাঁরা পাবেন না। পদোন্নতির ক্ষেত্রেও এই তিন বছর গণ্য হবে না। তবে পেনশনের ক্ষেত্রে গণ্য হবে। সরকারি সূত্রের খবর, অস্থায়ী থাকাকালীন মাসিক বেতন হবে গড়ে ৮৫০০ টাকা।
মহাকরণ সূত্রে বলা হচ্ছে, কিছু দিন আগেই মুখ্যমন্ত্রীকে ‘নোট’ পাঠিয়ে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কেরানির অসংখ্য শূন্য পদ তৈরি হয়েছে। কিন্তু নিয়োগ হয়নি। সরকারি কাজকর্ম চালাতে কর্মী নিয়োগ জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু রাজ্যের যা আর্থিক অবস্থা, তাতে স্থায়ী নিয়োগের বোঝা (বেতন-পেনশন) বহন করা সম্ভব নয়। |
সরকারি বিজ্ঞপ্তির অংশবিশেষের প্রতিলিপি। |
অথচ লোক নিয়োগ জরুরি। তাই তিন বছরের জন্য অস্থায়ী নিয়োগ করা যেতে পারে। প্রয়োজনে অস্থায়ী ভাবে নিযুক্ত কর্মীদের মধ্যে যাঁরা দক্ষ, তাঁদের ওই সময়ের পরে স্থায়ী করা হবে।
তার পরেই এই বিজ্ঞপ্তি। ফলে সরকারি ভাবে কর্মদক্ষতা যাচাই করার কথা বলা হলেও বাস্তবে কোষাগারের বেহাল দশাই আদেশনামার পিছনে মূল কারণ বলে মহাকরণের অনেক আধিকারিকের মত। অর্থ দফতরের এক কর্তা জানান, কর্মীদের বেতন-পেনশন দিতে এখন বছরে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা চলে যাচ্ছে। এ জন্য প্রায় প্রতি মাসেই বাজার থেকে ধার করতে হচ্ছে। কেরানিদের লক্ষাধিক শূন্য পদ স্থায়ী ভাবে পূরণ করতে হলে আরও কয়েক হাজার কোটি টাকার বোঝা চাপবে। তা করা কার্যত অসম্ভব। সেই কারণেই আপাতত গড়ে সাড়ে ৮ হাজার টাকা মাসিক বেতনে কেরানি নিয়োগ করা হবে। ফলে এই মুহূর্তে কোষাগারের উপর চাপ পড়বে তুলনামূলক ভাবে কম। অনেক রাজ্যে এমন ব্যবস্থা চালু আছে।
ওই আধিকারিকদের বক্তব্য, তিন বছর পরে চাকরি পাকা করার ব্যবস্থাই এত দিন চালু ছিল। পিএসসি পরীক্ষায় পাশ করা ব্যক্তিদের অস্থায়ী নিয়োগপত্র দেওয়া হতো। তিন বছর পরে পাকা চাকরির চিঠি দিয়ে বলা হতো, দু’বছর অস্থায়ী এবং এক বছর শিক্ষানবীশ থাকার পরে তাঁদের চাকরি পাকা করা হল। কিন্তু স্থায়ী পদের পুরো
বেতন, পদোন্নতি-সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা তাঁরা পেতেন চাকরির প্রথম
দিন থেকেই।
আধিকারিকদের অন্য একটি অংশ অবশ্য কর্মসংস্কৃতির উপরেই জোর দিচ্ছেন। তাঁদের মতে, সরকারি চাকরি পাওয়া মানেই পাকাপোক্ত বেতন-পেনশনের বন্দোবস্ত, এমন ধারণা তৈরি হয়ে যাওয়ায় বহু কেরানির
গোড়া থেকেই কাজ করার অভ্যাস গড়ে ওঠে না। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন জ্যোতি বসুও একদা বিরক্ত হয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘কাজ করতে বলব কাকে? চেয়ারকে?’ অথচ, রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের অধিকাংশই ‘গ্রুপ সি’ বা কেরানি। তাঁরাই সরকারের মুখ। তাই তাঁদের কাজ না-করাটা সরকারের ভাবমূর্তিতে আঘাত হানে। তিন বছর কড়া মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু থাকলে এবং বিভাগীয় পরীক্ষায় পাশ করা বাধ্যতামূলক হলে কাজ শেখা ও করার একটা অভ্যাস এবং দায়বদ্ধতা গড়ে উঠতে পারে বলে আধিকারিকদের ওই অংশের ধারণা। বেতন প্রসঙ্গে তাঁদের বক্তব্য, গোড়ায় কম বেতন দেওয়াটাও কর্মীদের চাপে রাখার একটা অঙ্গ। যাতে তাঁরা স্থায়ী পদে পুরো বেতন পাওয়ার যোগ্য হয়ে ওঠার জন্য মন দিয়ে কাজ করেন।
মূল্যায়ন ব্যবস্থা নিয়েও অবশ্য পাল্টা প্রশ্ন উঠেছে। বিরোধী দলের ঘনিষ্ঠ সরকারি কর্মচারী মহলের আশঙ্কা, এই মূল্যায়ন আসলে বিরোধী মতাবলম্বীদের ছেঁটে ফেলার কৌশল। তাঁদের মতে, তিন বছর যাঁরা শাসক দলের তাঁবেদারি করবেন না, তাঁদেরই অদক্ষ তকমা দিয়ে বিদায় করে দেওয়া হবে। এই আশঙ্কা ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন শাসক দল ঘনিষ্ঠ কর্মীরা। তাঁদের মতে, বাম আমলে দলীয় কর্মী ছাড়া কেউই সরকারি চাকরি পেতেন না। সেই অভ্যাসেরই ভূত এখনও দেখছেন বিরোধীরা। মহাকরণের খবর নতুন নিয়ম প্রয়োগের প্রথম ধাপে দীর্ঘদিন খালি পড়ে থাকা স্থায়ী ও অনুমোদিত’ তিন হাজার কেরানি পদে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে রাজ্য। সদ্যগঠিত স্টাফ সিলেকশন কমিশন (এসএসসি) এই নিয়োগ করবে। তবে সরকারি আদেশনামায় প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক, পুর-পঞ্চায়েত কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে কী করা হবে তা স্পষ্ট করে বলা নেই। অর্থ দফতরের কর্তারা অবশ্য বলছেন, বিধি বদল হয়েছে শুধু সরকারি চাকুরেদের জন্য। প্রাথমিক শিক্ষক বা পুরপঞ্চায়েত কর্মীরা সরকারি চাকুরে না হওয়ায় তাঁদের পুরো বেতনই পাওয়ার কথা। তবে অর্থ দফতর চাইলে তাঁদের ক্ষেত্রেও মূল বেতন দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি জারি করতেপারে। বস্তুত,পঞ্চায়েত ভোটের আগেই প্রায় ৪০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ করতে চলেছে স্কুল শিক্ষা দফতর। নতুন আদেশনামার পরে তাঁরাও পুরো বেতন পাবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। |