ফলতার মেয়ে শ্রমিকরা
মুখ বুজে হাড়-ভাঙা শ্রম,
মেয়েদের একই দিনলিপি
কাল থেকে ভাত রেঁধে ছেলেমেয়েদের দেখভাল করে, ছুটতে ছুটতে কোম্পানি গেটে যাওয়াটাই সার হল ভারতীর। ‘আজ আর তোকে লাগবে না’, বলে দিয়েছে সুপারভাইজার। ফিরে এসেই হাত মুখ ধুয়ে বসে পড়ে চাল ভাজতে। দু’ পয়সা আসবে তাতে। টানাটানির সংসারে আজকের রোজটা তার বড় দরকার ছিল। পরের জমিতে খাটে স্বামী। দু’জনের মাসিক রোজগার দু’শো কম পাঁচ হাজার টাকা। টেনেটুনে চলে।
ফলতা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি হয়েছিল ১৯৮৪ সালে। কাগজ, কলম, জুতো কারখানা রয়েছে, তবে সবচেয়ে বেশি রয়েছে ‘ক্যাঁচড়া কোম্পানি’। মানে পলিথিন কোম্পানি। ফলতার সেক্টর ১ আর সেক্টর ৫-এ বেশির ভাগই প্লাস্টিক কারখানা। তাতে গাঁ উজিয়ে কাজ করতে যায় পাশের হাইল্যান্ড, নৈনান গ্রামের মেয়েরা। আশির দশকে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির জন্য সেখান থেকে উচ্ছেদ হওয়া বাসিন্দাদের গ্রাম এগুলি। বেশির ভাগই ছোট চাষি ছিলেন তারা। জমি হারানোর পরে অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজই একমাত্র ভরসা তাদের।
পলিথিন কারখানার শ্রমিকদের ৬৫ শতাংশই মহিলা। সকাল ৬টা-২টো, ২টো-১০টার শিফ্ট। ছাঁটাই যখন তখন, দিনের কাজ পাওয়া না-পাওয়া মালিকের মর্জি।
“ক্যাঁচড়া কারখানায় মেয়ে এত বেশি কেন জান?” বলছিলেন আসুরা বিবি। “লেখাপড়া জানতে হয় না। মোজা জুতো, পেন কারখানায় তো মেয়ে কম। অনেক কম। মাপ জোক করতে হয় যে! এখানে শুধু চিকচিকিগুলো কাটলেই হয়। মাল বয়ে নিয়ে যায় ছেলেরা।” সেই জন্যই হয়তো ছেলেদের শ্রমের দাম বেশি! মেয়েদের যেখানে ১৬০ টাকা মজুরি, ছেলেদের সেখানে মজুরি ১৭০ টাকা। এটাই দস্তুর। কারখানার ভিতর ছেলে-মেয়ে কাজ করে আলাদা আলাদা। কিন্তু সুপারভাইজার? সে অবিশ্যি পুরুষমানুষ। কাজে চুক হলে মেয়েদের দিকে ছুটে আসে অশ্রাব্য কথার তোড়।
ফলতা বাণিজ্যের মুক্তাঞ্চল, কিন্তু সেখানকার মেয়েরা বাঁধা পড়ে রয়েছে অতি সামান্য মজুরির উন্নতিহীন শ্রমের আবর্তে। কাগজ মিল বা ক্যাঁচড়া কারখানা, সব থেকে কম মজুরির কাজ মেয়েদের দিয়েই করানো হয়। ফলতা শিল্পাঞ্চলে দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন বিজ্ঞানী পার্থসারথি রায়। তিনি বলেন, “মেয়েদের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা অনেক সোজা। পুরুষদের মজুরিতে না পোষালে অন্যত্র কাজ খুঁজে নেয়। মেয়েদের স্বামী-সংসার ফেলে অন্যত্র কাজ খোঁজার কোনও উপায় নেই।” পার্থসারথী জানান, কারখানার ভিতর অন্য রকম শোষণও চলে। সুপারভাইজারের জন্য রান্না করে নিয়ে যাওয়া থেকে যৌন হয়রানি। মুখ খুললেই কাজ হারানোর আশঙ্কা।
বাড়তি মজুরি চেয়ে কাজ খুইয়েছে পুষ্পা মণ্ডল। পুষ্পা বলেন, “মাইনে বাড়ানোর জন্য বলেছিলাম, তৃণমূলের ইউনিয়নের সঙ্গে সমঝোতা করে ২২ জনকে বসিয়ে দিয়েছে মালিক। তার মধ্যে আমরা পাঁচজন মেয়ে। অথচ পাঁচ বছর ধরে লড়াই করে ৬০ টাকা মজুরি বাড়িয়ে ১৫০ টাকা করলাম আমরাই। সেই মজুরি এখনও হাতে পাইনি।”
অন্য কারখানায় কাজ করতে যাননি কেন? “দুরত্বটা বড় কারণ। বাসভাড়া রয়েছে। শিফ্ট বদলাবে। সকালে রান্না করে বেরোতে পারব না, রাতের শিফ্ট থাকলে বাড়ি ফিরে খেতে দেওয়া, রান্না করা-- তাও পারব না। স্বামী রাগ করবে। তা ছাড়া, রাত হলে পাড়া পড়শি, আত্মীয় স্বজনও কি কথা বলতে ছাড়বে?” ন্যায্য মজুরির জন্য যে লড়াই করতে ছাড়ে না, স্বামী-পরিবার-পড়শির সঙ্গে সংঘাতে যেতে সে-ও পিছিয়ে আসে।
‘কাজ’ কি তবে এই মেয়েদের জীবনে সংসার চালানোর উপায় শুধু? সামান্য আত্মমর্যাদা আর স্বাধীনতার ছিটে ফোঁটাও জড়িয়ে নেই কি তার সঙ্গে? হয়তো নেই। তাই ছ’টা-দু’টোর শিফ্ট করে বাড়ি ফিরেই কাপড় কাচতে বসে যান আফসানা। ফিল্ডের কথা জিজ্ঞাসা করতেই চেঁচিয়ে ওঠেন --“কে বলল, আমি কাজ করি? আমি ফিল্ডে যাই না। কাজও করি না। আর যদিই বা করি, তোমাকে বলব কেন?...”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.