|
|
|
|
শহরে তিরতিরে উদ্বেগ, চলছে অঙ্ক পরীক্ষা |
নিজস্ব সংবাদদাতা • বহরমপুর |
এরপর থেকে কেবল দু’রকমই হতে পারে। এক, অঙ্কের সঙ্গে বাকি জীবনের মতো বিচ্ছেদ। বাজারে গিয়ে ডাল আলু কেনা বা বাসে টিকিট দিয়ে গুণে খুচরো ফেরত নেওয়া ছাড়া যোগ-ভাগ-গুণ-বিয়োগ থেকে যাবে কেবল জীবনের ওই সব খুচরো হিসেবেই।
অথবা, দুই, সারা জীবনের মতো বন্ধুতার সূচনা। যেটুকু শেখা গেল সেটুকু ভিত মাত্র। এ বার তার উপরে তৈরি হবে যার যেমন ক্ষমতা, তার তেমন ইমারত। সবাইকেই যে ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে, তার মানে নেই, নাসা বা ভাবায় গিয়ে গবেষণাও করতে হবে না, কিন্তু বিজ্ঞান নিয়ে পড়া তো যায়ই। সত্যি কথা বলতে কি, বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই তো এখন তাই করে।
সোমবার মাধ্যমিকের অঙ্ক পরীক্ষা শেষে প্রবীণ এক শিক্ষক এই কথাগুলিই বলছিলেন উৎকণ্ঠিত অভিভাবক-অভিভাবিকাদের সামনে। বেলা তখন দেড়টা। মেয়ে স্কুলে পরীক্ষা দিচ্ছে। বাইরে তার অভিভাবিকা বলছিলেন, “এই এক বাঙালি জীবনের পরম্পরা। আমি যখন মাধ্যমিকের অঙ্ক পরীক্ষা দিচ্ছিলাম, আমার মা এই ভাবেই বসে থাকতেন। আমার মেয়েও বসে থাকবে তার সন্তানের জন্য।” |
|
অঙ্ক পরীক্ষা শেষে স্বস্তি। |
মাধ্যমিকের অঙ্ক পরীক্ষা নিয়ে কেন এত চিন্তা? সকলেই প্রায় সমস্বরে বলে ওঠেন, জীবনের প্রথম এমন পরীক্ষা, যার খাতা জানা লোক দেখবেন না। এ যেন ঘর ছেড়ে প্রথমবার বাইরে পা ফেলা। ওই প্রবীণ শিক্ষকের কথায়, “শুধু তাই নয়, আরও একটা গুরুত্ব রয়েছে। আমাদের সমাজে অঙ্ক কে কেমন পারে, তার উপরেই যেন নির্ভর করে কার কেমন বুদ্ধি। এই চাপটাই বাচ্চা থেকে ধাড়ি, সকলের মনে চেপে বসে থাকে। আর তাতেই মাধ্যমিকের অঙ্ক পেয়ে যায় বাড়তি গুরুত্ব।”
আর সেই উদ্বেগ তাই ছড়িয়ে পড়ে সারা শহরেই। সরকারি নিষেধেই কেউ জোরে মাইক বাজাচ্ছেন না, কেউ মিটিং-মিছিলও করছেন না। কিন্তু তারপরেও যে পাড়ায় রয়েছে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী, সেই পাড়ার প্রায় সকলেই যেন এক সূক্ষ্ম সুতোয় জড়িয়ে পড়েছেন। সারা পাড়াই শান্ত। সঞ্জয় দত্ত হাসতে হাসতে বললেন, “শুধু আমার বাড়ি বলে নয়, সারা পাড়াতেই কেউ গলা তুলে ঝগড়া পর্যন্ত করছে না।” |
রিকশা দাঁড়াতেই লাফ |
সকাল সাড়ে দশটাতেই শহর সরগরম।
তখনও পরীক্ষা শুরু হতে দেড় ঘন্টা বাকি! গির্জার মোড় লাগোয়া স্কুলের গেটের সামনের রাস্তায় রিকশা দাঁড়াতেই ব্যাগ হাতে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল মেয়ে। হনহন করে কাশীশ্বরীর গেট পার হওয়ার মুখে মায়ের দিকে পিছন ঘুরে তাকাতেই হাত তুলে মেয়েকে থামতে বললেন মা স্বাগতা মুখোপাধ্যায়। হেঁটে মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে গলায় থাকা কালী মায়ের লকেট মাথায় ছুঁইয়ে দিলেন স্বাগতাদেবী। বিড়বিড় করে মেয়েকে বললেন, “ঠিক মতো পরীক্ষা দেবে কিন্তু!” ঘাড় নেড়ে মেয়ে চলে যায়। স্কুলের গেট পেরিয়ে চলে যাওয়ার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন মা।
তাঁর সম্বিত ফেরে আর এক অভিভাবিকা কল্যাণী মিত্রের ডাকে। কল্যাণীদেবীও এসেছেন মেয়ের জন্য। দু’জনে কথা বলতে বলতে স্কুলের গেটের এক পাশে সরে যান। উদ্বিগ্ন মায়েদের জটলা তৈরি হয়ে যায় তাঁদের ঘিরে। তত ক্ষণে স্কুলের গেটের ডান দিকে অন্য মায়েরা দখল নিয়েছেন কংক্রিট বেঞ্চের। সেখানেও উৎকণ্ঠা মুখের সারিতে।
এক পরীক্ষার্থী রিকশা থেকে তখনও নামেনি। অফিস থেকে বাবার ফোন। রিকশা থেকে নামতে নামতেই মা বিজয়া বসু মেয়ের হাতে মোবাইল তুলে দেন‘বাবা আমি স্কুলের সামনে পৌঁছে গিয়েছি। চিন্তা করো না।’ বলেই মায়ের হাতে মোবাইল দিয়ে রিকশা থেকে নেমে গেট পেরিয়ে যায়। তার কপালে চন্দনের বড় ফোঁটা।
অধিকাংশ পরীক্ষার্থীর কপালে এদিন চন্দনের বড় করে ফোঁটা। অন্য দিনও কপালে ফোঁটার ছোঁয়া থাকে। কিন্তু সোমবার অঙ্ক পরীক্ষা! তাই আকারে-বহরে বেড়েছে ফোঁটার চেহারা। কোনও কোনও কপালে লেপটে গিয়েছে দই-চন্দনের ফোঁটা।
সকাল ১১টা বাজতে না বাজতে স্কুলের গেটের সামনে ভিড় জমে যায় অভিভাবক-অভিভাবিকাদের। যান নিয়ন্ত্রণে পথে নেমে পড়ে ট্র্যাফিক পুলিশ। খাগড়া পুলিশ ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার তুহিন বিশ্বাসও চলে আসেন। সেই সময়ে স্কুলের এক শিক্ষিকা গাড়ি নিয়ে স্কুলের ভেতরে ঢুকতে গিয়ে অভিভাবকদের ভিড়ের মাঝে আটকে পড়েন। ভ্রু কুঁচকে মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে কাচ তোলা গাড়ির দিকে তাকিয়ে ফিসফাস শুরু হয়ে যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে তুহিনবাবু এগিয়ে যান। রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা অভিভাবকের মোটরবাইক সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধও করেন তিনি। |
চায়ের দোকানে, বেঞ্চে |
স্কুলের ডান দিকে পাঁচিল লাগোয়া প্রশস্ত জায়গায় খবরের কাগজ বিছিয়ে মাটিতেই বসে পড়েছেন মায়েরা। সেখান থেকে ভেসে আসে টুকরো কথা‘আজকের পরীক্ষা নিয়ে আলাদা ভয়’, ‘মেয়ে আজ ভোর ৪টেয় উঠে পড়েছে’, ‘পরীক্ষার দিন সকালে মেয়ে কিছুই খায় না’, ‘রাতেই রান্না করে রেখেছিলাম। সকালে শুধু ভাতটুকু করে মেয়ে আর ওর বাবাকে খেতে দিয়ে চলে এসেছি। আমি ফিরে গিয়ে খাব’, ‘মেয়ের পরীক্ষার কথা আর বলিস না, প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে, তার উপরে আজ অঙ্ক! কী যে হবে’...।
এরই মধ্যে অফিস যাওয়ার আগে কোনও অভিভাবক মেয়েকে মোটরবাইকে করে স্কুলের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যান। অফিস কামাই করে মেয়েকে নিয়ে এসে সকাল থেকে স্কুলের সামনেই ঘাঁটি গেড়েছেন কেউ। সরকারি কর্মী নিলয় মুখোপাধ্যায়, স্কুল শিক্ষক আবিরলাল বিশ্বাস, ব্যাঙ্ককর্মী নীল চট্টরাজ, ব্যবসায়ী গুপিনাথ কুণ্ডু একে-অপরের অপরিচিত। কিন্তু পরীক্ষার তিন ঘন্টা তাঁদের আরও ঘনিষ্ঠ করে দিয়েছে। স্কুলের গা-লাগোয়া চায়ের দোকান কিংবা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে চলছে আলোচনা। আড্ডায় সাম্প্রতিক রাজনীতির হাল-হকিকত থেকে ভেঙে পড়া উড়ালপুল, শিক্ষা ব্যবস্থা-স্বাস্থ্য, রাজ্য সরকারের পাওনা ডিএউঠে আসছে সবই। কেউ আবার একা বসে রয়েছেন কাছের কোনও পার্কে বেঞ্চে। |
|
|
শহরে অঙ্কের প্রহর। সকাল ১১টা ৩৫, রিকশা চাই পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছতে।
সকাল ১১টা ৪৫, শেষ মুহূর্তের পরামর্শ। |
|
ঠাকুমা নেমে এলেন |
এরই মধ্যে কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুলের সামনে কাঠের বাক্সের মধ্যে সাপ নিয়ে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মেয়েরা দল বেঁধে হানা দেয় অভিভাবকদের মাঝে। ‘মা তোদের মনের আশাপূর্ণ হবে। ১০ টাকা দে মা’ছেলেমেয়ের পরীক্ষা বলে কথা! অভিভাবক-অভিভাবিকারা ৫-১০ টাকা তাদের হাতে গুঁজে দেন। কেউ আবার স্বেচ্ছায় তাদের টাকা দেন। অভিভাবিকা দয়া ভকত বলেন, “মনে মনে ঠাকুরকে ডাকছি।” অন্য এক অভিভাবিকা চন্দনা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “মেয়ে তার ঠাকুমাকে প্রণাম করে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে আসছিল। কপালে চন্দনের ফোঁটা দিতে ভুলে গিয়েছিল। শাশুড়ি মনে করে দোতলা থেকে নেমে এসে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে দই ও চন্দনের ফোঁটা কপালে লাগিয়ে দেন।”
বাড়ি থেকে নিয়ে আসা পানীয় জল শেষ হয়ে যাওয়ায় মিষ্টির দোকানে ঢুকে জলের বোতল কিনে আনেন লক্ষ্মীদেবী। হুমড়ি খেয়ে পড়েন মায়েরা। নিমেষে তা শেষ হয়ে যায়। ফের চাঁদা তুলে নতুন ২টো বোতল কিনে আনা হয়। এভাবেই উদ্বিগ্ন-উৎকন্ঠায়, কথায়-আড্ডায় আড়াই ঘন্টা পার। তখন আড়াইটে বাজে। অভিভাবকদের দল যে যেখানে ছিলেন, সকলেই ভিড় করেন স্কুলের গেটের সামনে। প্রতীক্ষার অবসান শেষে স্কুলের শেষ ঘন্টা পড়তেই ছেলেমেয়েরা হই-হই করতে করতে স্কুলের গেট পার করে বেরিয়ে আসে। |
|
|
দুপুর ২টো, অভিভাবকদের
অলস দ্বিপ্রহর। |
বিকেল ৩টে, পরীক্ষা শেষ,
উত্তর মেলানোর পালা। |
|
তিনটে বাজতেই মুক্তি |
শহরের বিখ্যাত বিষ্ণুপুর কালীবাড়ির পুরোহিত পুণ্য চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, এই দিন সকালে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে বহু ছাত্রছাত্রী মন্দিরে প্রণাম করে গিয়েছেন। কেউ নিয়ে গিয়েছেন প্রসাদী ফুলও। এমনটা কী রোজই হচ্ছে? পুণ্যবাবু বলেন, “মাধ্যমিক শুরু হওয়ার পরে পুজো বেশি পড়ছে ঠিকই, তবে এই দিন ভিড় বেশি ছিল।” সকালের দিকে ছাত্রছাত্রীদের মা-ঠাকুমারা এসে পুজো দিয়ে গিয়েছেন। অঙ্কের শিক্ষক জয়ন্ত দত্ত বলেন, “এখন মাধ্যমিকের অঙ্কে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এখনও নানা কারণেই মাধ্যমিকের অঙ্কের ভীতিটা কাটেনি। বাবা-মায়েরাও ভুলতে পারেন না, তাঁদের অল্প বয়সে এই পরীক্ষা দেওয়ার সময় যে ভয় পেতেন, তার কথা। সেই ভয়টাই সামগ্রিক ভাবে পরের প্রজন্মের পরে চেপে বসে।” তিনটে বাজতেই সেই ভীতির হাত থেকে মুক্তি। বাবা-মায়েরা হাঁফ ছেড়ে বাঁঁচেনযাক শেষ পর্যন্ত পাটিগণিত, বীজগণিত, সম্পাদ্যের জটিল আবর্ত থেকে মুক্তি! আবার শুরু বাড়ি ফেরার জন্য তাড়াহুড়োর। ফের দৌড়ে দৌড়ে রিকশা ধরো। মঙ্গলবার আবার পরীক্ষা রয়েছে। এক অভিভাবিকা হেসেই ফেললেন, “পরীক্ষা শেষ হলে আমরাও বাঁচব। বাড়িতে যেন ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে।” এক অভিভাবক যে কথা শুনে বললেন, “মেয়ে মাধ্যমিক দিচ্ছে অতএব বাড়িতে টেলিভিশন বন্ধ, জোরে কথা বলা নিষিদ্ধ, গান শোনা তো অপরাধ বলে গণ্য হচ্ছে।”
|
—নিজস্ব চিত্র। |
|
|
|
|
|