|
|
|
|
পূজারার বেদিতে বিজয়-রথে ভারত |
রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায় • হায়দরাবাদ |
চেহারায়, চলনে-বলনে, জীবনযাপনে কিংবা ব্যাটিং-ধরনে দু’জনের মধ্যে কোনও মিল খুঁজে পাবেন না শত চেষ্টাতেও। ঘরানা আলাদা, মানসিকতা আলাদা, ভিন্ন জীবনবোধ।
এক জনকে সাউথ সিটি মল-এ স্বচ্ছন্দ দেখালে, অন্য জন মানানসই শ্যামবাজারে। এক জন যুগধর্ম মেনে হাতে ট্যাটু করাবেন। ফেসবুক পেজে ঢুঁ মারলে নামের পাশে ‘মঙ্ক’ বলে একটা শব্দ পাওয়া যাবে। না, সাধু-সন্ন্যাসী ইনি নন, ওটা বিশেষ পছন্দের লিকার-ব্র্যান্ডের নামের অনুকরণে রাখা। জনশ্রুতি হল, ভারতীয় ক্রিকেটে উদ্দামতায় যদি কেউ বিরাট কোহলির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেন, তো ইনি!
অন্য জন আবার মনের একাগ্রতা বাড়াতে ছুটবেন বডোদরায় যোগ-গুরুর কাছে। আধুনিকতার যুগেও যিনি সাবেকি। সনাতনী।
প্রথম জনমুরলী বিজয়।
দ্বিতীয় জনচেতেশ্বর পূজারা।
ভারতীয় ক্রিকেটের একেবারে বিপরীতধর্মী দুই চরিত্র। কিন্তু তাতে কী? রবিবাসরীয় উপ্পলের মাঠে একই নির্দিষ্ট লক্ষ্যে যে জাতীয় রোম্যান্সের জন্ম দিয়ে গেলেন। দু’জনেরই পকেটে অপরাজিত সেঞ্চুরি। এক যুগ আগে ইডেনের ভিভিএস-রাহুল অমর পার্টনারশিপ মনে পড়াল। দর্পচূর্ণ ঘটল অজি-ঐতিহ্যের। এবং দ্বিতীয় টেস্ট ঢুকে পড়ল এমন এক রানওয়েতে যেখান থেকে এক জনেরই জয়ের ফ্লাইট টেক-অফ করবে। নামটা গড়গড়িয়ে বলে দেওয়া যায়মহেন্দ্র সিংহ ধোনি।
খুব সহজে, পূজারার বেদিতে এখন টেস্টের বিজয়-রথে ভারত। |
জুটিতে লুটি |
|
|
ওড়ানোর খেলায় মুরলী-পূজারা। উপ্পলে রবিবাসরীয় বিনোদন। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস |
|
কিন্তু কোন শব্দবন্ধে ধরা যায় এই পূজারা-বিজয় মহাকীর্তি? যে ব্যাটিং-বিস্ফোরণ দেখে প্রায় উন্মত্ত হয়ে পড়ল আঠাশ হাজারের উপ্পল, মিনিটে-মিনিটে উঠল ‘মেক্সিকান ওয়েভ’। টনি গ্রেগ আজ কমেন্ট্রি বক্সে ছিলেন না। বেঁচে থাকলে নিশ্চিত বলতেন, ‘অ্যাবসোলিউট কারনেজ আউট দেয়ার।’ এতটাই অবিশ্বাস্য ধ্বংসলীলা।
সিডলকে হুক করে ফেলে পূজারা দেড়শোর গণ্ডিতে। একশো চল্লিশ কিলোমিটারের প্যাটিনসন-গ্রেনেড উড়ে যাচ্ছে বাউন্ডারিতে। ওভারে নিয়ম করে দু’-তিন বার! শান্তশিষ্ট, কপিবুক ক্রিকেটের ‘কপিবুক’ ছাত্র পূজারাকে কে কবে এমন রুদ্রমূর্তিতে দেখেছে?
মুরলী বিজয় পরপর স্টেপ আউটে ছুটছেন সেঞ্চুরির দিকে। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে মাইকেল ক্লার্ক। চোখে-মুখে ঘোর অবিশ্বাস। হবে না? মাত্র একটা সেশনের ব্যবধানে আদ্যোপান্ত জবুথবু দেখানো ওপেনার যে আগাম আইপিএল সিক্সের সৌরভ আনতে পারেন, কে ভেবেছিল?
দিনের শুরুতে ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়া যায়নি, ক্লার্কদের জন্য এমন মারণ-যজ্ঞ ওঁত পেতে আছে। বরং ভারতই তখন কেমন যেন চাপে ধ্বস্ত। ক্রিকেটমহলে হালফিলে একটা রসিকতা চালু হয়েছে বীরেন্দ্র সহবাগকে নিয়ে যে, বীরু এখন দু’ভাবে আউট হন। হয় শূন্য করে, নইলে একটা বাউন্ডারি মেরে! সহবাগ রবিবার দ্বিতীয় রাস্তাটা বাছলেন। ভারতকে আরও এক বার গভীর সঙ্কটে ফেলে দিয়ে, মোহালি টেস্টে নিজের স্লট নিয়ে প্রবল অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে। গোটা দিনে ওই এক বারই ভারতের টুঁটি চেপে ধরতে পারত ক্লার্কের অস্ট্রেলিয়া। বিজয়-পূজারা তখন ঠুকঠুক করছেন। প্রথম সেশনে উঠছে পঞ্চাশ রান, ঘুমপাড়ানি ক্রিকেট।
বোঝা যায়নি, ওটা পালটা মারের প্রস্তুতি ছিল।
দর্শনটা জানা গেল বিকেল নাগাদ। খেলা শেষে। পূজারাদের থিওরি ছিল: ডিফেন্স করে করে ফিল্ডিং টিমকে ক্লান্ত করে দাও। পেসাররা আগে উইকেটে ‘রাফ’-টা তৈরি করুক। তার পর চালিয়ে আড়াইশো-তিনশোর লিড এবং শেষে স্পিনের কড়াইয়ে ফেলে অস্ট্রেলিয়াকে ভেজে ফেলা। সেই প্রশ্নপত্রে আপাতত একশোয় একশো। লিড এখনই ৭৪ রানের, হাতে আরও ন’উইকেট, সবচেয়ে বড় কথা জরুরি পার্টনারশিপটা পাওয়া গিয়েছে। পূজারা-বিজয় সম্মিলিত ভাবে আপাতত ২৯৪ রানের মালিক। সোমবার স্কোরবোর্ড পাঁচশোর আশেপাশে পৌঁছলে, চতুর্থ দিনে ম্যাচ শেষের গল্পটাও যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য দেখাবে। আর পূজারা এখন শুধু ‘দ্রাবিড়োচিত’ নন, অন্তত উপমহাদেশের উইকেটে পূর্বসুরির যোগ্য উত্তরাধিকার। সারা দিনে এক বারও তাঁর ডিফেন্সকে বিব্রত করতে পারেনি অজি-বোলিং। উল্টে যথেচ্ছ কাট, পুল, ড্রাইভ গিলতে হয়েছে। বিজয়কে নিয়েও আর প্রশ্ন ওঠা উচিত নয়।
ক্রিকেট-রোম্যান্টিকদের খারাপ লাগতে পারে মাইকেল ক্লার্কের কথা ভেবে। কিন্তু কিছু করার নেই। ‘নিউক্লিয়ার ওয়ার’-এর যুগে গাদা বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ জেতা যায় না। ডোহার্টি-ম্যাক্সওয়েলরা রঞ্জি টিমেও ডাক পাবেন কি না সন্দেহ। নইলে আর দিনদুপুরে ম্যাথু হেডেন টুইট মারফত শেন ওয়ার্নকে ‘প্লিজ ফিরে এসো’ বলে ডাকাডাকি করেন? ’৮৬-র সিডনিতে গাওস্কর-অমরনাথের দ্বিতীয় উইকেট পার্টনারশিপ রেকর্ড ভেঙে জন্ম হয় নতুন কৃতিত্বের?
সচিন তেন্ডুলকরও তো পরোক্ষে একটা রেকর্ডের দিকে ধীরে ধীরে এগোচ্ছেন। আজ পর্যন্ত তাঁকে প্যাড পরে সবচেয়ে বেশি সময় বসে থাকতে হয়েছে সাত ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট। ১০৮ ওভার। ভারতীয় ইনিংসের ৯৩ ওভার কিন্তু হয়ে গেল!
|
অস্ট্রেলিয়া
প্রথম ইনিংস
(২৩৭-৯ ডিঃ) |
|
ভারত প্রথম ইনিংস
(৩১১-১) |
(আগের দিন ৫-০)
বিজয় নঃ আঃ ১২৯
সহবাগ ক ওয়েড বো সিডল ৬
পূজারা নঃ আঃ ১৬২
অতিরিক্ত ১৪
মোট ৩১১-১
পতন: ১৭
বোলিং: প্যাটিনসন ১৮-৭-৫৬-০, সিডল ১৯-৫-৫১-১, এনরিকে ১৯-৭-৩৮-০
ডোহার্টি ২৬-৭-৮৫-০, ম্যাক্সওয়েল ১০-১-৫৫-০, ওয়ার্নার ১-০-১৪-০ |
|
|
|
|
|
|
|