উল্টোডাঙা উড়ালপুল যেখানে ভেঙেছে, ওখানে বাঁকটা অনেকটা কাস্তের মতো। ফলে সেতুর ভারসাম্য যে সঙ্কটজনক অবস্থায় থাকতে পারে, এমন আশঙ্কা ছিলই। এখন মনে হচ্ছে, ওই ভারসাম্য ক্ষুণ্ণ হওয়ার ফলেই অঘটনটা ঘটে গেল।
রবিবার দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে সেতুটিকে যেটুকু দেখার সুযোগ হয়েছে, তার ভিত্তিতেই আমার এই অনুমান। সেতুর নকশা নিজের চোখে দেখার সুযোগ হয়নি। এখনও প্রশাসনের উদ্ধারকাজ চলছে, তাই দুর্ঘটনাস্থলের আঁতিপাতি খুঁটিয়ে দেখাও সম্ভব ছিল না। তবু গোলযোগটা মাত্রাতিরিক্ত বাঁকের জেরেই ঘটল বলে মনে হচ্ছে।
যে কোনও উড়ালপুলে মোচড়ের জায়গাটা সব সময়েই খুব গুরুত্বপূর্ণ। নকশা তৈরির সময় থেকেই ওই মোচড়ের ফলে কী কী ঘটতে পারে, তা আঁচ করার দূরদর্শিতা থাকা প্রয়োজন। যতটুকু জানা যাচ্ছে, লরিটা কিন্তু সেতুর গায়ে
ধাক্কা মারেনি। সে-ক্ষেত্রে হঠাৎ কী ঘটল, কেন সেতুর একাংশ খসে পড়ে গেল, তা স্পষ্ট হচ্ছে না। উড়ালপুলের একটা আস্ত গার্ডারই (সেতুটাকে ধরে রাখে যে লোহার বিম) খুলে পড়েছে। ধাক্কা লাগুক বা না-ই লাগুক, এমনটা কখনওই ঘটার কথা নয়।
এখন প্রশ্ন, এই বাঁকটাকে রেখেও অঘটন কী ভাবে এড়ানো যেত? আমার মনে হয়, কাস্তের মোচড়ের মতো বাঁকটা বজায় রাখতে হলে, মূল পরিকল্পনা ও নির্মাণকাজে কিছুটা রদবদলের দরকার ছিল। হয়তো সেতুর গঠন অন্য রকম করা যেত! কিংবা বাঁকের জায়গাটার মাঝে কোনও ভাবে বাড়তি ঠেকনা-র (ক্যান্টিলিভার) ব্যবস্থা করা গেলে ভারসাম্য বজায় থাকত। উড়ালপুলটার নীচের খালের পুব দিক থেকে হয়তো সেই চেষ্টা করা যেত। ঠিক কী করা যেত, তা অবশ্যই খুঁটিয়ে না-দেখে বলা যাবে না। তবে বাঁকের বিপদটা নিয়ে কোনও রকম আপস করা অভিপ্রেত নয়।
জানি না, সেতুর কাজ তড়িঘড়ি সারার কোনও চাপ ছিল কি না! সে তো সব সময়েই থাকে। বিদ্যাসাগর সেতু থেকে বিজন সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়ায় যুক্ত থেকে দেখেছি খরচ বা সময় বাঁচানোর বাধ্যবাধকতা তখনও ছিল। কিন্তু নিরাপত্তার বিষয়টিতে যাতে আপস করা না-হয়, তা তো দেখতে হবে।
একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। ’৭৪-’৭৫ সালে ক্যানাল ওয়েস্ট রোডের উপরে সেতু নির্মাণের সময়ে তদানীন্তন মন্ত্রী ভোলা সেন হঠাৎ ফরমান জারি করলেন। বলা হল, এক মাসের মধ্যে আমাদের কাজ সারতে হবে। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সব দিক চিন্তা করেই তখন আমাদের পরিকল্পনায় রদবদল করে সময়ে কাজ সারতে হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে কী
ঘটেছে, তা আমার জানা নেই। সে-বিচারে যেতেও চাই না। কিন্তু এই উড়ালপুলের বাঁকটা দেখেই পরিকল্পনার গোড়ায় গলদের দিকটা উড়িয়ে দিতে পারছি না।
একটা সেতু তৈরি হওয়ার দু’বছরের মাথায় তার একাংশ ভেঙে পড়বে, এটাও অভাবনীয় ঘটনা। দু’বছরে তো নতুন বাড়ি রং করারও দরকার পড়ে না। যৎসামান্য রক্ষণাবেক্ষণ বজায় থাকলেই এই উড়ালপুল একেবারে নতুনের মতো থাকার কথা ছিল। অবাক হয়ে দেখলাম, একটা আস্ত গার্ডার থাম থেকে খুলে পাক খেয়ে পড়েছে। কী ভাবে এটা ঘটল? সেতুর গার্ডার আঁকড়ে ধরতে যে ধরনের গোলাকার দাঁড়া-বসানো বেয়ারিং (পিটিএফই) ব্যবহার করা হয়েছে, তা কতখানি পোক্ত ছিল সেটাও ভাববার বিষয়। দু’বছরের মধ্যে বেয়ারিং ঢিলে হয়ে যাবে, এটা কখনওই প্রত্যাশিত নয়। উড়ালপুলে অতখানি মোচড়ের জন্য ব্যবহৃত বেয়ারিং কতটা উপযুক্ত ছিল, তা কি নির্মাণকাজ শুরুর আগে খতিয়ে দেখা হয়েছিল? তা ছাড়া, বেয়ারিং ছোট-ছোট কংক্রিটের টুকরোর মধ্যে বসানো থাকে। সেই কংক্রিটের মান কেমন ছিল, তা-ও খতিয়ে দেখা উচিত। তবে স্রেফ চোখে দেখেই সেতুর উপকরণের মান নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়। একাধিক প্রথম সারির প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে প্রযুক্তির সাহায্যে এই বিষয়গুলি যাচাই করা উচিত।
জানি না, তদন্তে কী বোঝা যাবে! তবে সেতুর নকশা ও নির্মাণে অভিজ্ঞ পেশাদার ইঞ্জিনিয়ারদের সাহায্য কিন্তু অবশ্যই নিতে হবে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সবটা হবে না। ত্রুটি শুধরে নিয়ে কলকাতার নাগরিক-জীবনকে ছন্দে ফেরাতে এ ছাড়া আর অন্য পথ নেই। |