অন্ধকার তখনও ভাল করে কাটেনি। রবিবার ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল উল্টোডাঙার শ্রীকৃষ্ণ কলোনি ও আশপাশের বাসিন্দাদের। আওয়াজ যেখান থেকে এসেছে, সেখানে গিয়ে আতঙ্কে, বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠল তাঁদের। দেখলেন, আক্ষরিক অর্থেই জলে চলে গিয়েছে দু’বছর আগে তৈরি ঝাঁ চকচকে নতুন উড়ালপুল!
নিছক চাঙড় খসা কিংবা এক পাশের গার্ড ওয়াল ভেঙে পড়া নয়। ভিআইপি রোড-ইএম বাইপাস সংযোগকারী উড়ালসেতুটির দুই স্তম্ভের মধ্যবর্তী অংশ (গার্ডার) খুলে পড়ে গিয়েছে কেষ্টপুর খালের জলে! কাকভোরের আধো অন্ধকারে বাসিন্দারা ভয়ার্ত বিস্ময়ে আরও দেখলেন, ভেঙে পড়া সেতুর মাঝে আটকে রয়েছে মার্বেলবোঝাই একটি অতিকায় ট্রাক। বারো চাকার ট্রেলার-লরির কেবিন থেকে ভেসে আসছে আর্ত চিৎকার। চালক-খালাসি তার ভিতরে আটকে! এক জন খালের ধারে পড়ে রয়েছেন। তিনিও ট্রাকে ছিলেন।
|
সেতুভঙ্গের প্রবল শব্দ ও চিৎকার-চেঁচামেচিতে ততক্ষণ চার দিক সচকিত। দলে দলে মানুষ দৌড়ে আসতে শুরু করেছেন। প্রথমে তাঁরাই উদ্ধারে নামেন। পুলিশ এলে তিন ট্রাক-কর্মীকে জিপে চড়িয়ে হাসপাতালে পাঠানো হয়। পুলিশ জানিয়েছে, ওঁদের নাম সইফুদ্দিন (২৫), খালেক মহম্মদ (৩২) ও শেখ মজিদ। খালেক লরির চালক। তাঁর ও মজিদের বাড়ি রাজস্থানে। সইফুদ্দিন কলকাতার ছেলে। রাজস্থান থেকে মার্বেল নিয়ে তাঁরা বাইপাসের এক মার্বেল-গুদামে আসছিলেন। প্রথমে খালেক-মজিদকে আরজিকরে ও সইফুদ্দিনকে বিধাননগর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরে সইফুদ্দিনকে এক বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
ডাক্তারেরা জানিয়েছেন, তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক।
দুর্ঘটনা আরও অনেক ভয়াবহ আকার ধারণ করতেই পারত। হয়নি দু’টি কারণে। প্রথমত ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ উড়ালপুলটিতে দিনে-দুপুরের মতো গাড়ির ভিড় ছিল না। দ্বিতীয় কারণ চার যুবকের মানবিকতা। দুর্ঘটনার শিকার হওয়া লরিটির পিছনেই ছিল চার যুবকের গাড়ি। উড়ালপুল ভেঙে লরিটি পড়ে যাওয়ার পরে কোনও রকমে গাড়িটি ঘুরিয়ে তাঁরা ফিরে আসেন উড়ালপুলে ওঠার মুখে। গাড়িটিকে আড়াআড়ি ভাবে দাঁড় করিয়ে দেন। তাঁদের তৎপরতায় বহু গাড়ি উড়ালপুলে না উঠে অন্য রাস্তা ধরে। এই চার যুবক তৎপর না হলে বা দিনে-দুপুরে উড়ালপুলটি ভেঙে পড়লে কী দশা হত, তা ভাবতেই শিউরে উঠছেন অনেকে।
সকাল ছ’টা নাগাদ দমকল ও বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী পৌঁছায়। আরও কোনও গাড়ি বা মানুষ জলে পড়েছে কি না, তা যাচাই করতে সকালে বিপর্যয় মোকাবিলার ডুবুরিরা খালে নামেন। তাঁদের দাবি, তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কাউকে পাওয়া যায়নি। |
ভিআইপি থেকে বাইপাসমুখী সেতুর কাস্তের মতো একটি বাঁক থেকে ভেঙে নীচের খালের জলে ঝুলে পড়েছে প্রায় ৫০ মিটার লম্বা অংশটি। প্রযুক্তি পরিভাষায় এই ধরনের বাঁককে বলা হয় ‘কার্ভড বক্স গার্ডার।’ কেএমডিএ-র আধিকারিকেরা এ দিন ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে জানান, উড়ালপুলটির ওই অংশটাই একেবারে শেষে তৈরি হয়েছিল। তাঁদের দাবি, একটা স্তম্ভ থেকে বেয়ারিং খুলে গিয়ে গার্ডারটি ঝুলে পড়ে। ফলে অন্য দিকটা গার্ডারের ভার সহ্য করতে পারেনি, সে দিকটাও ভেঙে যায়।
কিন্তু এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা উড়ালপুল দু’বছরের মধ্যে ভেঙে পড়ল কেন? রাজ্যের পুর-নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এ দিন ঘটনাস্থলে এসে এর জন্য পরোক্ষে পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের দিকে আঙুল তুলেছেন। “বাম আমলে এই উড়ালপুল উদ্বোধন করা হয়েছিল খুব তাড়াহুড়োয়। আমরা বার বার বলেছিলাম, তাড়াহুড়ো না-করে নিরাপত্তার দিকটা ভাল করে যাচাই করে নিতে।” দাবি ফিরহাদের। তাঁর কথায়, “রবিবারের ঘটনাটি ঠিক কী কারণে ঘটেছে, কিংবা কোথায় গাফিলতি ছিল, সে সব বিশেষজ্ঞেরাই বলতে পারবেন। যাদবপুর বা শিবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং-বিশেষজ্ঞরা দেখে রিপোর্ট দেবেন।” একই সঙ্গে কলকাতা শহরে বাম আমলে তৈরি অন্য উড়ালপুলগুলো কতটা পোক্ত, বিশেষজ্ঞেরা তা-ও যাচাই করবেন বলে জানিয়েছেন ফিরহাদ।
তৃণমূলের পুরমন্ত্রীর ‘তাড়াহুড়ো’র অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছেন বাম জমানার পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “এই কাজে কোনও তাড়াহুড়ো করা হয়নি। বরং সেতুটি বানাতে নির্ধারিত সময়ের বেশি-ই লেগেছে।” সেতু তৈরির সময়কার কেএমডিএ-র দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক দেবদাস ভট্টাচার্যেরও একই দাবি। তাঁর বক্তব্য, “কোনও তাড়াহুড়ো হয়নি। বরং ওই কার্ভের জায়গাটা খুব সাবধানে বানানো হয়েছিল। |
|
|
চলছে দুর্ঘটনার কারণ খোঁজা।
সেতু পরীক্ষায় বিশেষজ্ঞরা। |
কেউ আটকে নেই তো? তল্লাশিতে
বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী |
|
উড়ালপুলের নক্শা, ড্রয়িং, নির্মাণের উপকরণ সবই ঠিক ছিল। গত দু’বছরে কোনও সমস্যা হয়নি। উড়ালপুলের বাঁকের মুখে গাড়ি যাতায়াতেও অসুবিধা ছিল না।”
বিকেলে ঘটনাস্থলে আসেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষকদের একটি দল। তাঁরা ভেঙে যাওয়া অংশের নমুনা সংগ্রহ করেন। আপাত ভাবে নির্মাণগত কোনও ত্রুটি তাঁদের নজরে আসেনি। স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিশেষজ্ঞ গোকুল মণ্ডল বলেন, “এই ধরনের উড়ালপুলে নক্শা তৈরিটা গুরুত্বপূর্ণ। আপাত ভাবে মনে হচ্ছে, বাঁকের জায়গাটায় কিছু ত্রুটি থাকতে পারে।” যদিও প্রকল্পের নক্শাকার ‘কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস’-এর দীপঙ্কর পাল নক্শায় ত্রুটির তত্ত্ব মানতে নারাজ। “সবই পরীক্ষা করা হয়েছিল। কেএমডিএ তদন্ত করে দেখুক।” মন্তব্য তাঁর।
সেতুটি বানিয়েছিল সরকারি সংস্থা ম্যাকিনটস বার্ন। এ দিন সন্ধ্যায় বিধাননগর পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। সংস্থা-কর্তৃপক্ষ কী বলেন? সংস্থার তদানীন্তন এমডি নীলমণি ধরের বক্তব্য, “ওই রকম বাঁকের কাজটা সত্যিই দুরূহ। ১৫ জন ইঞ্জিনিয়ারের দল নিষ্ঠার সঙ্গে তা করেছিলেন।” তা হলে কেন দুর্ঘটনা?
নীলমণিবাবুর ব্যাখ্যা, “সেতুতে বেয়ারিঙের উপরে থাকে গার্ডার। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভারী ও দ্রুতগামী লরিটি সেতুর পাঁচিলে ধাক্কা দেয়। তাতেই সম্ভবত সেতুর বেয়ারিং নড়ে গিয়ে গার্ডার স্থানচ্যুত হয়েছে।” তাঁর দাবি: উড়ালপুলের ওই বাঁকে গাড়ির গতিবেগ ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটারের বেশি হওয়ার কথা নয়। ভারী গাড়ি হলে তা আরও কম হওয়া বাঞ্ছনীয়।
উল্লেখ্য, সেতুভঙ্গের ঘটনায় ট্রাকচালক মহম্মদ খালেকের নামেও বেপরোয়া গাড়ি চালানোর অভিযোগ রুজু করেছে পুলিশ। পুর দফতর-সূত্রের খবর: উড়ালপুলটি চালু হওয়ার পরে তাতে ভারী গাড়ি ওঠায় বিধি-নিষেধ ছিল। তা সত্ত্বেও বারো চাকার লরিটা উঠল কী ভাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিধাননগর ও কলকাতার পুলিশ-কর্তাদের অবশ্য দাবি: কেএমডিএ-র কাছ থেকে ওই সেতুতে ভারী গাড়ি ওঠার নিষেধাজ্ঞা জারির কোনও নির্দেশ তাঁরা পাননি। পাঁচ-দশ বছরের মধ্যে দৈনিক কী হারে গাড়ি চলাচল হতে পারে, উড়ালপুল চালু করার আগে সেই সমীক্ষাও (ট্র্যাফিক স্টাডি) করা হয়নি বলে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে।
ঘটনাচক্রে, ক’দিন আগে নতুন এই উড়ালপুলেরই ইএম বাইপাসের দিকে তিন স্তম্ভের কাছে ফাটল ধরা পড়েছিল। যদিও এ দিনের দুর্ঘটনার সঙ্গে তার যোগসূত্র নেই বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। তবে সেতুর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ কতটা ঠিকঠাক করা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নগরোন্নয়ন-কর্তাদের একাংশ। ওঁদের দাবি, রক্ষণাবেক্ষণেও ত্রুটি রয়েছে। পুর দফতরের খবর: কাজ শেষ হওয়ার পরে এক বছর পর্যন্ত (৩১ ডিসেম্বর ২০১০ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০১১) উড়ালপুলটি দেখভালের দায়িত্ব ছিল নির্মাতা সংস্থারই হাতে। তারা সরে যাওয়ার পরে সেই দায়িত্ব আর কাউকে দেওয়া হয়নি। কেএমডিএ-র আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, দেড় কিলোমিটারের বেশি লম্বা উড়ালপুলটি নির্মাণের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল উল্টোডাঙা মোড়ের যানজট কমানো। বস্তুতই নতুন সেতুর সৌজন্যে গত দু’বছরে উল্টোডাঙা মোড়ের পরিচিত যানজটের ছবি অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছিল।
কিন্তু রবিবার সকাল থেকে উড়ালপুলের দু’দিকই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যান চলাচল তালগোল পাকিয়ে যায়। উল্টোডাঙা মোড়ে ও ভিআইপি রোডে জমে যায় গাড়ি-বাসের দীর্ঘ লাইন।
ফিরে আসে পুরনো সেই দৃশ্য। |
উড়ালপুলের ইতিবৃত্ত |
কলকাতায় ম্যাকিনটস বার্নের তৈরি সেতু |
• কাজের দায়িত্ব পায় কেএমডিএ
• নকশা বানায় কন্সালটিং ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস
• নির্মাণ করে সরকারি সংস্থা ম্যাকিনটস বার্ন
• কাজ শুরু ২০০৮-এর জুলাইয়ে
• শেষ হওয়ার কথা ছিল ১৮ মাসে
• দেরির জন্য ব্যয় ৪৯ কোটি থেকে হয় ৬৮ কোটি
• বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য উদ্বোধন
করেন ৫ জানুয়ারি, ২০১১ |
• ইএম বাইপাসে অম্বেডকর সেতু,
(কেএমডিএ-র তত্ত্বাবধানে)
• লেক গার্ডেন্স উড়ালপুল
(পূর্ত দফতরের তত্ত্বাবধানে)
• দ্বিতীয় হুগলি সেতুর অ্যাপ্রোচ
(এইচআরবিসি-র তত্ত্বাবধানে)
• খিদিরপুর
(এইচআরবিসি-র তত্ত্বাবধানে) |
এক দশকে দেশে বড় সেতু-দুর্ঘটনা |
• সেপ্টেম্বর ’০২ রফিগঞ্জ রেল সেতু ভেঙে রাজধানী এক্সপ্রেস নদীখাতে। মৃত্যু ১৩০
• অক্টোবর ’০৫ ভেলিগোন্ডা রেল সেতু। মৃত্যু ১১৪
• ডিসেম্বর ’০৬ ভাগলপুরে পথ-ব্রিজ ভেঙে নীচে চলন্ত ট্রেনের উপরে। মৃত্যু ৩২
• সেপ্টেম্বর ’০৭ হায়দরাবাদে নির্মীয়মাণ পাঞ্জাগুট্টা সেতু। মৃত্যু ২০
• ডিসেম্বর ’০৯ কোটা চম্বল সেতু। মৃত্যু ১০। নিখোঁজ ৪০
• ডিসেম্বর ’১২ মুম্বইয়ে বিমানবন্দরের কাছে সেতু। মৃত্যু ৩ |
|
ছবিগুলি তুলেছেন: শৌভিক দে, সুদীপ্ত ভৌমিক
তথ্য সহায়তা: শুভাশিস ঘটক ও কাজল গুপ্ত
|