রাস্তায় গাড়ির স্রোত। দোকানপাট খোলা। শেয়ার বাজার আর ব্যাঙ্কে লেনদেন চলছে আর পাঁচটা দিনের মতোই।
জামাতে ইসলামির ডাকা হরতালের ছবিটা ঢাকায় এ রকমই। আর এই হরতালকেই ঢাল করে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করে দিলেন বাংলাদেশের বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া। তাঁর এই পদক্ষেপ ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক তো বটেই, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রেও দূরপ্রসারী বার্তা দিল বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা।
১৯৭৪-এ ভি ভি গিরির পরে দ্বিতীয় ভারতীয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে আজ ঢাকায় এসেছেন প্রণববাবু। কোন ঢাকা? যে ঢাকায় শাহবাগের আন্দোলন তুঙ্গে। জামাতের চোরাগোপ্তা হানায় আজও নানা জায়গায় ২২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। তবু তারই মধ্যে শহরের মোড়ে মোড়ে দু’দেশের পতাকা। ভারতের রাষ্ট্রপতির হাসিমুখের ছবি, নীচে লেখা, ‘স্বাগত’। মানুষ ভিড় করেছেন প্রণববাবুকে দেখার জন্য। |
ঢাকায় স্বাগত। ছবি: পিটিআই |
রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে প্রথম বিদেশ সফরের গন্তব্য হিসেবে প্রণববাবু নিজেই বেছে নিয়েছেন, বাংলাদেশ। বর্ষীয়ান রাষ্ট্রপতি হেসে বলেছেন, “এ দেশকে তো আমার বিদেশ বলেই মনে হয় না। নিজের ভাষায় কথা বলি, ভীষণ চেনা মুখগুলো।” আর ভারতীয় হাইকমিশনে দু’লাইনের মেল পাঠিয়ে প্রণববাবুর সেই সফরই বয়কট করেছেন খালেদা জিয়া। সেই খালেদা, যিনি এক রকম ঝুলোঝুলি করেই গত নভেম্বরে দিল্লি সফরের আমন্ত্রণ আদায় করেছিলেন। দিল্লি গিয়ে প্রণববাবুর সঙ্গে দেখা করে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিলেন। তার পরে ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সলমন খুরশিদের সঙ্গে বৈঠকে জানিয়েছিলেন, প্রণববাবুর সঙ্গে তাঁর অনেক কথা রয়েছে। কিন্তু আজ প্রণববাবুর সঙ্গে বৈঠক বাতিল করে খালেদা বুঝিয়ে দিলেন, সামনের ভোটে ভারত-বিরোধিতার সুর চড়ানোই হবে তাঁর রণকৌশল।
ভারত কী চোখে দেখছে খালেদার এই পদক্ষেপকে? বিদেশসচিব রঞ্জন মাথাই বললেন, “খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে আসবেন না বলে জানিয়েছেন। ব্যাস, এর বেশি কিছু বলা আমাদের শোভা পায় না।” আর প্রণববাবুর প্রতিক্রিয়া? রাষ্ট্রপতি ভবনের এক অফিসারজানান, সকালে রওনা হওয়ার আগেই তিনি খবরটা পান। প্রণববাবুর মুখের হাসি কিছু ক্ষণের জন্য উধাও হয়ে যায়। তবে কোনও মন্তব্য করেননি।
আন্দোলনের শাহবাগ কিন্তু প্রণববাবুর সফর নিয়ে রীতিমতো উত্তেজিত। রাস্তার একটা অংশ চকের ঘর টেনে দখল নিয়েছেন বিন্তি। বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। নিজে কোনও দিন রাজনীতি করেননি বছর কুড়ির এই ছাত্রী। নতুন যুদ্ধে তাঁর দখলে নেওয়া রাস্তাটুকুর নাম ‘সেক্টর ১৩’। বিক্ষোভকারী থেকে শাহবাগ থানার ওসি, বিন্তিকে সকলেই সেক্টর ১৩-র কমান্ডার বলে ডাকেন। আবেগে দীপ্ত মেয়েটির কথায়, “আমাদের সৌভাগ্য যে প্রণববাবু ঢাকায় এসেছেন। শুনেছি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অনেক সাহায্য করেছেন তিনি। এ-ও তো আর এক স্বাধীনতার যুদ্ধ। তাঁর সফরে নিজেদের উজ্জীবিত লাগছে।” |
কোথায় হরতাল? একুশের শহিদ মিনারের সামনে টুপি উড়িয়ে উল্লাস
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়া স্নাতকদের। রবিবার। —নিজস্ব চিত্র |
কুড়ি দিন রাস্তা কামড়ে পড়ে রয়েছেন বিন্তি আর তাঁর দলবল। এঁরা কারা? মিষ্টি হেসে তাঁর উত্তর, “কেউ ব্লগার তো কেউ আর্টিস্ট। জনা চল্লিশ। জানেন, পথের কাগজকুড়ুনি ছেলেরাও রয়েছে আমার দলে। নিজেদের উপার্জন থেকে তারা টিফিন কিনে আমাদের সকলকে খাওয়ায়!
অথচ দলের কাউকে আমি আগে চিনতাম না।”
বিক্ষোভকারীরা আজ গিয়েছিলেন পুরনো ঢাকায় বাহাদুর শাহ পার্কে। সেখানে হাজারো মানুষ এ দিনও তাঁদের কথা শুনেছেন। জাতীয় পতাকায় মুড়ে দিয়েছেন চারপাশ। রাজাকারদের ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন। জামাতকে নিষিদ্ধ করার ধ্বনি তুলেছেন। ভরা বিকেলে শুনশান শাহবাগের মোড়ে রাতের পরে রাত জেগে ক্লান্ত কিছু তরুণ জিরিয়ে নিচ্ছিলেন। কাঁটাতারের ব্যারিকেডের আড়ালে গিটারের তারে আঙুল পড়ছিল টুংটাং। এমন সময়ে লাউড স্পিকারে বেজে উঠল গান, ‘জান কবুল, আর মান কবুল। আর দেবো না ধান...।’ মুহূর্তে আবার চাঙ্গা শাহবাগ।
এই আবহেই আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছেন প্রণববাবু। নতুন কোনও কথা বলতে তো তিনি আসেননি, বলার কথাও নয়। তবু তাঁর এই পাশে থাকাটাই হাসিনাকে বল-ভরসা দেবে। মৌলবাদকে ঠেকানোর লড়াইয়ে এটাই তো চাইছে শাহবাগ!
|