|
|
|
|
তারাবাজি |
আমাদের ড্রেসিংরুমে মন ভাল করে দেওয়া লোকটাকেই পাব না
ওয়াসিম আক্রম এ বছর থাকছেন না কেকেআর-এর সঙ্গে। দলের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা
কোচিং স্টাফের অন্যতম সদস্য জয়দীপ মুখোপাধ্যায় লিখছেন সম্ভাব্য নিঃসঙ্গতা নিয়ে |
বালাজির সেই দুঃস্বপ্নের ওভারটা এখনও মনের মধ্যে মাঝে মাঝে ঝলসে ওঠে। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের রায়ডু আর ফ্র্যাঙ্কলিন ওই শেষ ওভারে ২১ রান করে সেদিন কলকাতা নাইট রাইডার্সের প্রথম দুইয়ে থাকার আশায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। ইডেনের গ্যালারিতে ৭০ হাজার মানুষ তখন বাকরুদ্ধ। মাঠে আমাদের খেলোয়াড়রা হতাশ। ডাগ আউটে কোচ হোয়াটমোর ও আমরা, সমস্ত সাপোর্ট স্টাফ বিস্ময়ে হতবাক। এ কী হল? মাত্র ছ’টা বলের মধ্যে যে এ ভাবে আমাদের স্বপ্নের ইমারত তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে, তা ভাবাই যায়নি। সে ২০১১-র আইপিএলের ঘটনা। গত বছর আমরা চ্যাম্পিয়ন না হলে সেই ক্ষতে কোনও দিন প্রলেপ পড়ত কি না কে জানে। সেই একটা ওভার হয়তো অনেকেরই মনে আছে। কিন্তু আমার মনে আছে সে দিনের আর এক ঘটনা।
তখন বালাজিই খলনায়ক। বালা নিজেও প্রচণ্ড হতাশ। এতটাই হতাশ যে, তখন কারও সঙ্গে কথা বলা তো দূরের কথা, দলের কারও দিকে তাকাতেও পারছে না। এমনই পরিস্থিতি। এই অবস্থায় যে লোকটা ড্রেসিং রুমে ঢুকেই বালাকে বুকে জড়িয়ে ধরল, তার নাম ওয়াসিম আক্রম। দু’মিনিটের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক। দল ফের চাঙ্গা। সব কিছু ঠিকঠাক। দলের চেহারা দেখে কে বলবে, কিছুক্ষণ আগে এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে।
এ বার আইপিএলে এই কাজটা কে করবে?
আইপিএল আসলে একটা লম্বা সফর। বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে বেরিয়ে পড়ো। দু’মাস ধরে এ শহর, ও শহর ঘুরে, মাঝে মাঝে নিজের শহরে এসে উত্তেজনায় ঠাসা একগাদা ম্যাচ খেলো পরপর। নিয়মিত প্র্যাক্টিসও আছে। শারীরিক ক্লান্তি তো বটেই, মানসিক ক্লান্তিও দলের ছেলেদের জড়িয়ে ধরে। তাই দলে এমন একজনকে দরকার হয়, যে ছেলেদের চাঙ্গা রাখতে পারে সমানে। ওয়াসিম ভাই সেই লোক। |
এ বার নেই |
যখন শুনলাম, ছেলেদের সময় দেওয়ার জন্য এ বার আর আমাদের টিমের সঙ্গে থাকতে পারবে না আমাদের ওয়াসিম ভাই, তখন সবার আগে এই চিন্তাটাই মাথায় এল। সদা হাস্যময় এই ভদ্রলোককে ছাড়া আমাদের চলবে কী করে?
ওর হোটেলের ঘরের দরজা সব সময় খোলা। যে যখন খুশি ঘরে ঢুকে ওয়াসিম ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে আসতে পারে। অবারিত দ্বার বলতে যা বোঝায়, একেবারে তা-ই। আমিও মাঝে মাঝে ওর সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা মেরেছি। আড্ডা মারার ব্যাপারে ভাই যেন একেবারে আদ্যোপান্ত বাঙালি। ওয়াসিম আক্রম না হয়ে সে যদি উত্তর কলকাতার কোনও পাড়ার অমুক-দা বা তমুক-দা হত, তা হলেও দিব্যি মানিয়ে যেত। আর এই আড্ডার আসরে সবার মন জয় করে নেওয়াটাই ওর বৈশিষ্ট্য। কলকাতার বাইরে গিয়ে সারা দিনের কাজের পর ওর সঙ্গে কোনও পাবে বা রেস্তোরাঁয় আড্ডায় বসা মানে অনায়াসে সময় কেটে যাওয়া তো বটেই, মনটাও তাজা হয়ে যায়। সারা দিনের ক্লান্তিও কেটে যায় কয়েক মুহূর্তের মধ্যে।
কত গল্প ওর ঝুলিতে। ক্রিকেটার হয়ে ওঠার গল্প থেকে শুরু করে, ইমরান খানের সঙ্গে ওর সম্পর্ক, বিশ্বকাপ জয়ের নানা কাহিনি, কত কী শুনেছি ভাইয়ের মুখে। এক বার মাঠে কথা কাটাকাটি হওয়ার পর ড্রেসিং রুমে ভিভ রিচার্ডস ওকে ডেকে পাঠিয়েছিল এবং পুরো ঘটনাটা শেষ পর্যন্ত কী ভাবে মজাদার হয়ে ওঠে, সেই গল্পও শুনেছি ওর কাছে। আর সেই আড্ডা হবে না।
জন বুকানন চলে যাওয়ার পর এবং ডেভ হোয়াটমোরের কোচ হয়ে আসার আগে নাইট রাইডার্সের একটা ক্যাম্প হয়েছিল গুরগাঁওতে। সেই ক্যাম্পেই ওয়াসিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার আলাপ। বিশ্বাস করুন, প্রথম দিন কথা বলতে বলতেই আমার কেমন যেন মনে হল, এই লোকটাকে যেন আমি ২০-২৫ বছর ধরে চিনি। কী অদ্ভুত ওর আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা। এমনিতেই ওর ব্যক্তিত্ব ও সুদর্শন চেহারা দেখে মেয়েরা প্রেমে পড়ে যায়। যারা ওর সঙ্গে মেশার সুযোগ পায়, তাদের যে কী অবস্থা হতে পারে, সেটা নিশ্চয়ই আন্দাজ করে নেওয়া যেতে পারে। ওর স্বাস্থ্য সচেতনতা দেখে লজ্জা পেতে পারে দলের ক্রিকেটাররাও। ওয়াসিম ভাইকে জিম করতে দেখাটা একটা অভিজ্ঞতা বটে। পুরো সেশনের পর যখন ও জিম থেকে বেরোয়, তখন দেখে মনে হয়, কোনও মিডল ওয়েট বক্সার বেরোচ্ছে। খাওয়ার ব্যাপারেও যথেষ্ট সচেতন। যেহেতু ওর ডায়াবেটিস আছে, তাই খাওয়াদাওয়া নিয়ে খুঁতখুঁতে ভাবটা একটু বেশিই। কিন্তু খাওয়াতে ভালবাসে খুব। আমি অনেক বার বলেকয়ে মাত্র এক বার ওকে খাওয়ানোর ‘মিশন’-এ সফল হয়েছি। কখনও ‘বিল’ দিতে দেবে না। সে বার তাই আগে থেকে অনেক বার বলে শেষে ম্যানেজ করা গিয়েছিল।
নাইটদের খেলোয়াড়দেরও এ ভাবেই আচ্ছন্ন করে রেখেছে ওয়াসিম আক্রম। একাধারে সে দুর্দান্ত এক শিক্ষক, অভিভাবক। অন্য দিকে সে ভীষণ কাছের এক বন্ধু।
কত দিন দেখেছি, নেট প্র্যাক্টিসের শুরু থেকেই বল হাতে নিয়ে বোলিং শুরু করে দিল। দলের বোলারদের সমান এনার্জি ওর। সারাক্ষণ ধরে পেস বোলারদের নজরে নজরে রাখে। কার কোন জায়গায় ভুল হচ্ছে, তা নিজেই হাতেকলমে করে দেখিয়ে দেওয়াটাই ওর স্টাইল। হোটেলে ফিরে ভিডিয়ো দেখিয়ে বা বোর্ডে এঁকে বোঝানোর ধার ধারে না। টেকনিকের ছোটখাটো ব্যাপারগুলোও নিজের হাতে শুধরে দেওয়ার পক্ষপাতী। কেমন অনায়াসে কঠিন সমস্যাগুলোর সহজ সমাধান করে দেয়। দলের কোনও বোলারের সমস্যা হয়েছে আর সেই সমস্যার সমাধান হয়নি, এমন কোনও ঘটনা আমার জানা নেই। কত সহজে এক জন পেস বোলারের সমস্যা সমাধান করে, তাকে পুরো পালটে দিতে পারে, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ মহম্মদ সামি। আগের সামি আর এখনকার সামির মধ্যে যে তফাত দেখা যাচ্ছে, তা যে ওয়াসিম আক্রমের জন্যই, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
এমন এক জনকে এ বার সারা আইপিএলে পাব না! ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি একটা দুশ্চিন্তাও হচ্ছে, ছেলেগুলোকে এ বার চাঙ্গা রাখব কী করে? নিশ্চয়ই টিম ম্যানেজমেন্টও এই নিয়ে চিন্তায় পড়েছে।
ট্রেভর পেনি এ বার আমাদের দলের সঙ্গে থাকবেন শুনেছি। ছেলেদের জন্য কোনও মোটিভেটর আসবেন কি না জানি না। তবে এটা জানি, ওয়াসিম ভাইয়ের মতো বড় মোটিভেটর দলে থাকলে অন্য কারও দরকার হত না। |
|
|
|
|
|