কাজ শেষে বিকেলে বাড়ি ফিরছিল মেয়েটি। বাড়ির সামনে প্রায় পৌঁছেও গিয়েছিল সে। আচমকাই তার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারে পড়শি এক যুবক। এলাকায় সমাজবিরোধী হিসেবে পরিচিত মুখ আব্দুল রহিমকে দেখে চিৎকার করে ওঠে মেয়েটি। হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। হট্টগোলে আশাপাশের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন পাড়ার লোকজন। নিজের কুকর্মের ‘ছক’ ভেস্তে গিয়েছে বুঝতে পেরে এ বার পকেট থেকে ওয়ান শটারটা বের করে মেয়েটির বুকে সরাসরি চালিয়ে দেয় ওই পড়শি যুবক। বাড়ির সামনেই মুখ থুবড়ে পড়ে মারা যান মহসিনা খাতুন (২২)। শনিবার ভর-বিকেলে ‘এগোলেই গুলি ফুঁড়ে দেব’ বলে গ্রামবাসীদের শাসিয়ে ধীরেসুস্থে এলাকা ছেড়ে যায় রহিম। রাত পর্যন্ত ধরা পড়েনি সে।
মালদহের সুজাপুরে চামাগ্রাম বড় জনপদ। এ দিন বিকেলে সেখানে লোকজনও ছিল যথেষ্ট। তাঁদের সামনে কী করে এমন ঘটনা ঘটল?
গ্রামবাসীরা স্পষ্টই বলছেন, রহিমকে বাধা দেওয়ার ‘ক্ষমতা’ নেই তাঁদের। গত কয়েক বছর ধরেই এলাকায় ‘ত্রাস’ হিসেবে পরিচিত সে। কখনও সিপিএম, কখনও বা শাসক দলের আশ্রয়ে তার বাড়বাড়ন্ত। তবে পুলিশের এক অংশের দাবি, সম্প্রতি সে ঝুঁকেছিল কংগ্রেসের দিকে। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রায় নিয়মিতই ডাকাতি কিংবা তোলাবাজির ঘটনায় উঠে আসত রহিমের নাম। বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনায় সে সরাসরি জড়িত। তবে বড় মাপের অপরাধ করেই সে রাজনীতির ‘দাদাদের’ প্রশ্রয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিত। এমনই দাবি স্থানীয় অন্তত সাত-আটটি গ্রামের বাসিন্দার। পরিস্থিতি থিতিয়ে গেলে এলাকায় ফিরে ফের স্বমূর্তি ধরত রহিম। পুলিশের খাতাতেই তার বিরুদ্ধে রয়েছে অন্তত ৯টি খুন এবং বেশ কয়েকটি ধর্ষণ, বোমাবাজি, তোলা আদায়ের অভিযোগ।
এ দিন বিকেলে ঘটনার পরেই চামাগ্রামে গিয়েছিলেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা রাজ্যের নারী ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র। তাঁর অভিযোগ, “রহিম তো দীর্ঘ দিন ধরে কংগ্রেস আশ্রিত দুষ্কৃতী। আমি পুলিশ সুপারকে বলেছি দ্রুত তাকে গ্রেফতার করতে।” জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাক আলম অবশ্য পাল্টা বলেন, “ওই ঘটনায় আমাদের দলের কেউ জড়িত নয়। আসলে জেলায় আইনশৃঙ্খলার অবনতি আড়াল করতেই এখন রহিমকে আমাদের আশ্রিত দুষ্কৃতী বলে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।” প্রায় একই দাবি সিপিএমের মালদহ জেলা সম্পাদক অমর মিত্রের। তিনি বলেন, “রাজ্য জুড়ে যে আইনশৃঙ্খলা বলে কিছু নেই, এ ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে তা আবার দেখিয়ে দিল।”
স্থানীয় গ্রামবাসীরাই জানান, মাস খানেক আগে গ্রামে ফিরেছিল রহিম। কিন্তু পুলিশের কাছে সে খবর থাকা সত্ত্বেও তাকে গ্রেফতার করা হয়নি কেন? জেলা পুলিশ সুপার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমি সেই ব্যাপারটাই স্থানীয় থানার কাছে জানতে চেয়েছি।” তিনি অবশ্য আশ্বস্ত করছেন, রহিমকে ধরতে সীমান্তে জাল পাতা হয়েছে। খুব দ্রুতই ধরা পড়ে যাবে ওই দুষ্কৃতী।
স্থানীয় গ্রামবাসীদের সঙ্গে মহসিনার মা মঞ্জুরা বেওয়া-ও জানান, বেশ কয়েকদিন ধরেই তাঁর মেয়েকে উত্যক্ত করছিল ওই যুবক। তাঁর আক্ষেপ, “মেয়েটা আমার বড়ই শান্ত ছিল গো, খুব সাদাসিদে। একটা চোখ নষ্ট। রাতে তাই ভাল দেখতে পেত না। তা নিয়েই কাজ করত।”
মা জানান, রহিম কিছু দিন ধরেই মহসিনাকে বিরক্ত করছিল। তিনি বলেন, “কিন্তু ওর বিরুদ্ধে থানায় যাব, সে সাহস আমাদের হয়নি। পাড়ার লোকজনকে বলেছিলাম, কেউ-ই সাহস করে বাধা দিতে পারেননি। সেই রাগ থেকেই মেয়েটাকে গুলি করে মারল রহিম!”
বছর কয়েক আগে মারা গিয়েছেন বাবা। সাত ভাই-বোনের সংসারটা একাই টানতেন মহসিনা। স্থানীয় এক ঠিকাদারের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতেন তিনি। আবদুর রউফ নামে সেই ঠিকাদারও বলেন, “একটা চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল মেয়েটির। তবু কাজে খামতি ছিল না। খুব ভদ্র।” রহিম ওঁকে উত্যক্ত করছে শুনেও বাধা দিলেন না কেন? রউফ স্পষ্টই বলেন, “সে সাহস আমাদের নেই দাদা!” |