এক দিকে স্কুল-কলেজে নিয়োগ থমকে রয়েছে। অন্য দিকে গবেষণার সুযোগও অত্যন্ত কম। ফলে, হাতখরচ চালানোর মতো উপার্জনটুকুও করতে পারছেন না কৃতী ছাত্রছাত্রীরা। এর মধ্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পড়ুয়াদের অবস্থা সবচেয়ে সঙ্গীন।
২০১৩ শিক্ষাবর্ষে পিএইচডি-র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সেখানে আসন সাকুল্যে ২৫টি। সম্প্রতি তার ফল প্রকাশ হয়েছে এবং সব আসনেই ভর্তি প্রক্রিয়া মিটে গিয়েছে। ফেলোশিপ পাওয়া আবেদনকারীর সংখ্যাই ৮০। এ ছাড়াও রয়েছেন নেট, সেট, এমফিল ও রেট (রিসার্চ এলিজিবিলিটি টেস্ট) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীরা। সব মিলিয়ে আবেদনপত্র জমা পড়েছে ২১০টি। অর্থাৎ, সুযোগ মিলবে আবেদনকারীর এক-অষ্টমাংশের। একই চিত্র যাদবপুর, বর্ধমান থেকে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের।
উচ্চশিক্ষায় প্রতিযোগিতা তথা সীমিত আসন থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী, ফেলোশিপ পাওয়ার দু’বছরের মধ্যে পিএইচডি পাঠ্যক্রমে নাম নথিভুক্ত করাতে হয়। না-পারলে তা বাতিল হয়ে যায়। তখন আবার নতুন করে সব কিছু শুরু করতে হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলি জানাচ্ছে, তাদের হাত-পা বাঁধা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাসের বক্তব্য, “আমরা ইচ্ছে মতো আসন বাড়াতে পারি না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নিয়ম আমরা মানতে বাধ্য।” তিনি যোগ করেন, “বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় যেমন, অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজে নিজস্ব অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা-ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে ইউজিসি-র মতো কোনও নির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ নেই, জেআরএফ বা নেট ব্যবস্থাও নেই। আসলে বিদেশে যাঁরা উচ্চশিক্ষায় থাকতে চান, তাঁরাই শুধু পিএইচডি করেন। ওদের ব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের তুলনা চলে না।”
২০১২ শিক্ষাবর্ষ থেকে নেট পরীক্ষায় ‘মাল্টিপল চয়েজ কোয়েশ্চেন’ (এমসিকিউ) পদ্ধতি চালু করেছে ইউজিসি। ফেলোশিপের সংখ্যা যেমন বাড়ানো হয়েছে, তেমনই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রমশ বেড়েছে আবেদনকারীর সংখ্যা। ইউজিসি ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, সবর্র্শেষ প্রকাশিত ২০১১ ডিসেম্বরের তুলনায় ২০১২ জুনের নেট পরীক্ষায় মোট ফেলোশিপ বেড়েছে প্রায় চারশো। ওই বছরই নেট পাশ করা পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় চার গুণ ১০,৬২২ থেকে ৪০,৩৩২। কিন্তু সেই হারে বাড়েনি আসনসংখ্যা। আবার তা যে আনুপাতিক হারে বাড়ানো সম্ভব নয়, তা ইউজিসির নিয়মেই স্পষ্ট। ফলে তৈরি হয়েছে সঙ্কট।
ইউজিসি-র নিয়মানুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা এক সঙ্গে আট জনের বেশি গবেষককে পিএইচডি করাতে পারবেন না। কোনও-কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি শিক্ষক থাকলেও তাঁরাও এক সঙ্গে তিন জনের বেশি নিতে পারেন না। বর্তমানে বেশির ভাগ বিশ্ববিদালয়েই স্থায়ী শিক্ষকদের অধিকাংশেরই আর নতুন গবেষক নেওয়ার জায়গা নেই। তার উপরে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন নিয়োগ না হওয়ায় শিক্ষকসংখ্যাও কমেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের বিভাগীয় প্রধান সুচরিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “আমরা আন্তরিক ভাবে চেষ্টা করছি ফেলোশিপ পাওয়া ভাবী গবেষকদের অগ্রাধিকার দেওয়ার। কিন্তু এত আবেদনপত্র জমা পড়েছে, চার দিনে ইন্টারভিউ করতে হয়েছে! আমরা চেষ্টা করছি, কিছু আসন ফাঁকা হলে আবার দ্রুত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার।”
গত শিক্ষাবর্ষে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনসংখ্যা ছিল ১৯। তার প্রেক্ষিতে আবেদনকারীদের মধ্যে জেআরএফ (জুনিয়র রিসার্চ ফেলো)-র সংখ্যাই ৪০। মোট আবেদনকারী প্রায় দেড়শো। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪টি আসনের প্রেক্ষিতে আবেদনকারীও প্রায় দেড়শো। বিশ্বভারতীতে ১১টি আসনের প্রেক্ষিতে জেআরএফ সত্তরেরও বেশি। এ ছাড়া আছেন এমফিল, নেট, পিএইচডি ‘কোর্স-ওয়ার্ক’ শেষ করা ছাত্রছাত্রীরা। একই চিত্র বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়েও। সেখানেও কিছু দিনের মধ্যেই একশোরও বেশি আবেদনকারীর মৌখিক পরীক্ষা হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আবেদনকারীর কথায়, “গবেষণার জন্য নিয়ম করে এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেই চলেছি। ইন্টারভিউ দিচ্ছি। হচ্ছে না।” |