ভোরবেলা দরজায় জোর কড়া নাড়ার শব্দে বিধুডাক্তারের ঘুম ভেঙে গেল। সন্ধেবেলা শহরের একটা রেসের ঘোড়ার চিকিত্সা করে গ্রামে ফিরে শুতে শুতে অনেক রাত হয়েছিল। ভোরে আচমকা ঘুম ভেঙে বিরক্ত হয়ে দরজা খুলতেই দেখল তার সামনে দলবল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এ অঞ্চলের দুর্ধর্ষ ডাকাত মরণচাঁদ। লোকে তার এই নাম মুখে আনে না, এখানকার আট-দশটা গ্রামের মানুষের কাছে তার ‘জলডাকাত’ নামটাই চালু। সমুদ্রে যেমন জলদস্যুর আতঙ্কে জাহাজসুদ্ধু সবাই কাঁপে, নদীতে নদীতে মাখামাখি এই সব অঞ্চলে তেমনই জলডাকাতের ভয়ে বড় বড় নৌকোর যাত্রীরা কাঁটা হয়ে থাকে। মরণচাঁদ এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় জলডাকাত।
তাকে সামনে দেখে বিধুডাক্তার বলল, ‘বরাবর তোকে বুদ্ধিমান বলেই জানতাম। এখন দেখছি ঘটে তোর ছিটেফোঁটা বুদ্ধিও নেই। আগে মানুষের চিকিত্সা করে কিছুই পেতাম না, এখন ঘোড়ার ডাক্তারি করে তাও পাই না। আর তুই এলি আমার ঘরে ডাকাতি করতে! তাও আবার জল ছেড়ে স্থলে!’
মরণচাঁদ হাত জোড় করে বলল, ‘না ডাক্তারবাবু, ডাকাতি করতে আসিনি। এসেছি ঘোড়ার চিকিচ্ছে করাতে।’
ডাক্তারের ভুরু কুঁচকে গেল ‘ঘোড়া? তোর বাহন তো নৌকো! দেখি তোর কেমন ঘোড়া?’
‘নৌকোয় রেখে এসেছি। খাবি খাওয়া ঘোড়া, অ্যাদ্দূর হাঁটিয়ে আনা যাবে না। আপনি যদি একটু কষ্ট করে নদী অব্দি আসেন ডাক্তারবাবু, আপনার এক মাসের খোরপোশ চলে যাবার মতো টাকা আমি দেব। আপনি আমাদের মা-বাপ, ডাক্তারবাবু।’
বিধুডাক্তারের নিজের ঘোড়া বুড়ো হয়েও কখনও খাবি খাওয়ার মতো হয়নি। বরাবরের মতোই আজও সে প্রভুকে নিয়ে এ-গ্রামে ও-গ্রামে দিব্যি যেতে পারে। যখনই ঘোড়ার কোনও অসুখ করেছে, বিধুডাক্তারের ওষুধে সেরে গিয়েছে। নিজের ঘোড়ার চিকিত্সা করতে করতে বিধুডাক্তার এখন মানুষের চেয়ে ঘোড়ার ডাক্তার হিসেবেই বেশি পরিচিত। আশপাশের অনেক গ্রামেই লোকে তাকে ঘোড়ার ডাক্তার বলেই চেনে।
নৌকোর পাটাতনে কাত্ হয়ে ঘোড়াটা শুয়ে আছে, দূর থেকে দেখে বিধুডাক্তার সোজা ভাটার নদীতীরের জলকাদায় নেমে গেল।
ঘোড়াটার চোখ খোলা। জোরে জোরে শ্বাস টানতে খুবই কষ্ট হচ্ছে দেখে বিধুডাক্তার বলল, ‘এর শ্বাসনালীতে ভারী কিছু আটকে আছে। একে বাঁচানোর সাধ্য আমার নেই।’ |
কাছেই নারকোলগাছের গুঁড়ি ফেলে তৈরি ঘাটের একটা ধাপে চাদরে বাঁধা একটা পোঁটলা। সে দিকে আঙুল দেখিয়ে মরণচাঁদ বলল, ‘ওই টাকার পোঁটলা থেকে আপনি যত চান, দেব। ঘোড়াটাকে বাঁচান।’
‘আমি তো অস্ত্রচিকিত্সা জানি না। আর এ খুব শক্ত অপারেশনের কাজ। তাতেও যে বাঁচবে তার গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না।’
‘ওষুধে ওকে বমি করানো যায় না, ডাক্তারবাবু?’
‘ভাবছি শ্বাসনালীতে কী আটকালো! ঘোড়া তো আর মাংস খায় না যে হাড়ের টুকরো ফুটবে।’
‘আপনার বমির ওষুধ নেই? খুব বেশি করে বমি হওয়ার ওষুধ দিলে কাজ হবে না?’
‘ব্যাপারখানা কী রে? ভেঙে বল তো। ডাক্তারের কাছে আর উকিলের কাছে
কিছু লুকোতে হয় না জানিস তো? যতটুকু জানিস বল।’
‘আমি বাবু সবটাই জানি। নদে-জেলার পাশে যশোরে কাল মাঝরাতে বড়সড় একটা দাঁও মেরে বেরিয়ে আসছি, এমন সময়, জেলাপুলিশের মধ্যেই আমার এক গুপ্তচর আছে, সে খপর পাঠাল পুলিশের বড় সাহেব আজ আমার ডাকাতি করতে আসার কথা জেনে গিয়েছে। ভারী মতো একটা দল নিয়ে রওনা হয়েছে আমাকে ধরতে। মিথ্যে বলব না, সামান্য নগদ টাকা আর সোনার গয়না ছাড়া কিছুই নিইনি। পাশের গ্রামের স্যঁাকরাকে ঘুম থেকে তুলে তক্ষুনি সব গয়না গলিয়ে সেই সোনার তাল এই বুড়ো ঘোড়ার গলায় জোর করে ঢুকিয়ে দিলাম। ঘোড়াটা আগে থেকেই নদীর ধারে বিরাট একটা তেঁতুলগাছের তলায় শুয়ে ধুঁকছিল।’
‘পুলিশ ধরতে পারেনি?’
‘বড় দারোগা আমার তিনটে নৌকো তন্নতন্ন করে খুঁজেও একতিল সোনা পায়নি। চোরাই মাল না পেলে ডাকাত ধরবে কী করে?’
‘তিন-তিনটে নৌকো, তোর অতগুলো ষণ্ডামার্কা লোক। তোকে বিনা সন্দেহে
ছেড়ে দিল?’
‘ঘোড়াটা শুয়ে শুয়ে খাবি খাচ্ছে দেখে সন্দেহ হয়নি, তা নয়। আমি বললাম, খিদের মুখে বিরাট একটা কাঁঠাল খেয়ে ওটার এই অবস্থা, হুজুর।’
‘ঘোড়ার কাঁঠাল গেলার গল্প দারোগা বিশ্বাস করল?’
‘করিয়ে দিলাম। বললাম, আজ্ঞে, এ হল গিয়ে কাঁঠালি গ্রামের ঘোড়া। ওখানে সব বাড়ির উঠোনেই দু’চারখানা কাঁঠাল গাছ আছে। গাছভরা কাঁঠাল। গাছের কাণ্ড থেকেই এক-দু’কুড়ি কাঁঠাল ঝোলে। মাটি ছোঁয় ছোঁয় অবস্থা! তা সেই পাকা কাঁঠালের গন্ধে
ঘোড়ার নেশা লেগে যায়, গাছে থাকতেই কামড় লাগায়!’
মরণচাঁদের কুকীর্তির কথা শুনতে শুনতে ডাক্তার ঘোড়াটাকে দু’চার রকমের ওষুধ খাইয়ে বুকে কপালে হাত বুলিয়ে শেষ পর্যন্ত অনেক কৌশলে গলায় ডাক্তারি সাঁড়াশি ঢুকিয়ে মাঝারি মাপের একটা সোনার তাল বের করে আনল।
মরণচাঁদ হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। খুশি হয়ে টাকার পুঁটুলিটা ডাক্তারের দিকে এগিয়ে দিতে গেল। ডাক্তার বলল, ‘ডাকাতির টাকা আমি ছোঁব তুই ভাবলি কী করে? ঘোড়াটাকে এখুনি পেট ভরে ভাতের ফ্যান আর ঘাস-জল খাওয়া, ওষুধ দিয়েছি, দ্যাখ যদি বাঁচে।’
বলে ডাক্তার হন হন করে এগিয়ে গেল। বাড়ির দিকে না, অন্য রাস্তায়।
মরণচাঁদ ঘরে ফিরে মেঝেয় সোনার তাল লুকোবার গর্তটুকুও খোঁড়বার সময় পেল না, তার আগেই তার বন্ধ দরজায় মৃদু টকটক শব্দ!
দলেরই কেউ ভেবে মরণচাঁদ দরজা খুলে দিতেই ধীর পায়ে ঘরে এসে ঢুকল
সদাশান্ত দারোগা।
সে বার জলডাকাত মরণচাঁদের চার বছরের জেল হল।
এ গল্প এখানেই শেষ। কিন্তু এক সময়কার দোর্দণ্ডপ্রতাপ ‘ছুঁলেই-কারাদণ্ডী দারোগা’ কী করে মৃদুভাষী ‘সদাশান্ত দারোগা’ হলেন, সে এক আলাদা কাহিনি। |