|
|
|
|
উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন আডবাণীদের |
দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় • নয়াদিল্লি |
বাকি রইল শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণা। সেটুকু বাদ দিলে আজ বিজেপির জাতীয় পরিষদের মঞ্চে এক রকম অভিষেকই হয়ে গেল নরেন্দ্র মোদীর। প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার দৌড়ে বাকিদের অনেক পিছনে ফেলে বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে গেলেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী।
ইঙ্গিতটা এসেছিল গত কালই। বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মোদীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন সভাপতি রাজনাথ সিংহ। আর আজ জাতীয় পরিষদের বৈঠকে গোটা দেশ থেকে আসা কয়েক হাজার বিজেপি নেতার মাঝে রাজনাথ যখন বক্তব্য রাখতে শুরু করলেন, তখনও তিনি যে মোদীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবেন, তা প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু সেই প্রত্যাশাকেও ছাপিয়ে গেলেন বিজেপি সভাপতি। মোদীর জয়, গুজরাত মডেল, আন্তর্জাতিক মহলে মোদীর গ্রহণযোগ্যতা, তাঁর সুশাসন নিয়ে প্রশংসার মাঝেই বলে উঠলেন, “শুধু কথা দিয়ে মোদীকে স্বাগত জানানো পর্যাপ্ত নয়। আমার মনে হয়, সকলে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে ওঁকে স্বাগত জানানো উচিত।”
বলাটুকুরই যেন অপেক্ষা ছিল। দিল্লির তালকাটোরা স্টেডিয়াম মুহূর্তে মোদী-ময়। সামনে বসা নেতাদের উচ্ছ্বসিত জয়ধ্বনি তো ছিলই। মঞ্চে বসে থাকা লালকৃষ্ণ আডবাণী, সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলি, নিতিন গডকড়ীরাও উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে শুরু করলেন। আর তিনি? মোদী? লাজুক মুখে দাঁড়িয়ে অভিনন্দন কুড়োলেন বিজেপির পোস্টার বয়। সেই সঙ্গে চলল আডবাণী-সহ প্রবীণ নেতাদের প্রণামের পালা। রাজনাথ মালা পরিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। দেওয়াল লিখন স্পষ্ট হয়ে গেল আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির মুখ এই নরেন্দ্র মোদীই। ভবিষ্যতে দলের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীও তিনিই। আজ বেসরকারি ঘোষণাটা হয়ে গেল। রাজনাথ অবশ্য মুখে বললেন, এই মহাড়ম্বর শুধু মাত্র মোদীর তৃতীয় বারের জয়ের জন্য। কিন্তু গোটা দেশে তিনি যে বার্তাটি দিতে চেয়েছিলেন, তা ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে সর্বত্র। কাল সকালেই মোদী বক্তৃতা দেবেন পরিষদের বৈঠকে। বিজেপি কর্মীরা চান, এ বার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পর্বটিও সেরে ফেলা হোক।
মোদীর এই অভিষেকের সময় আরএসএসের তরফে সঙ্ঘের অন্যতম শীর্ষ নেতা সুরেশ সোনিও সভায় হাজির ছিলেন। সঙ্ঘ সূত্রের মতে, কংগ্রেসকে বার্তা দিতেই ধাপে ধাপে মোদীর উচ্চতা এ ভাবে বাড়ানো হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, সঙ্ঘ যখন মোদীকেই বিজেপির মুখ করে ভোটে যেতে চাইছে, তা হলে আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় এত দেরি কেন?
সঙ্ঘ ও বিজেপি নেতারা বলছেন, মোদীকে আনুষ্ঠানিক ভাবে নেতা ঘোষণার ব্যাপারে এখনও অনেক বাধা রয়েছে। প্রথমত, বিজেপিরই অনেক শীর্ষ নেতা এখনও চান না, মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদের প্রার্থী করা হোক। কিন্তু মোদী-বিরোধীরা এ-ও বুঝতে পারছেন, মোদী ছাড়া এই মুহূর্তে দলের কাছে আর কোনও মুখও নেই। সম্প্রতি সঙ্ঘ এক সমীক্ষা করেছে, যাতে স্পষ্ট, একমাত্র মোদীকে তুলে ধরলেই বিজেপি ১৫০-১৮০টির কাছাকাছি আসন জিততে পারে। না হলে কংগ্রেস একক ক্ষমতায় কেন্দ্রে ফের সরকার গড়তে পারে বলেও তাতে জানা গিয়েছে। মোদীকে তুলে ধরলে কংগ্রেসের পিছড়ে বর্গের ভোটব্যাঙ্কেও থাবা বসাতে পারবে বিজেপি। মূলত শহর কেন্দ্রিক দল বলে পরিচিত বিজেপি ভোট টানতে পারবে গ্রামেও।
দ্বিতীয়ত, নীতীশের মতো শরিক দলের নেতার মোদীর নামে ঘোরতর আপত্তি। যদিও বিহার বিজেপির নেতাদের মতে, নীতীশ যতই আপত্তি তুলুন, এনডিএ ছেড়ে কংগ্রেসের সঙ্গে যাওয়া তাঁর পক্ষে অতটা সহজ হবে না। আর তিনি জোট ছাড়লে বিজেপি বিহারে ভাল ফল করবে হবে। বিহারের বিজেপি নেতা গিরিরাজ সিংহও বলেন, “আজ রাজনাথ যে ভাবে মোদীকে স্বাগত জানিয়েছেন, তাতে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হোক বা না হোক, কিচ্ছু যায়-আসে না।” নীতীশ ছাড়া আর কোনও শরিক নেতারই মোদীর নামে আপত্তি নেই। অকালি থেকে বর্তমান শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরে সকলেই মোদীকে সমর্থন জানান। এই অবস্থায় নীতীশ-কাঁটা ভাবাচ্ছে অরুণ জেটলিকেও। তবে আত্মবিশ্বাসী
জেটলি এ-ও বলেন, “রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকেই। সেটা মেটানোই রাজনীতির পারদর্শিতা।” |
|
স্বাগত মোদী। বিজেপির জাতীয় পরিষদের বৈঠকে। ছবি: পি টি আই |
এই দু’টি কারণের পাশাপাশি আরও একটি বিষয় মাথায় রাখছেন বিজেপি নেতারা। মোদীকে এখনই তুলে ধরলে কংগ্রেস তাঁকে বেগ দেওয়ার চেষ্টা করবেই। বিজেপির একটা বড় অংশ মনে করেন, মোদী যতই উন্নয়নের মন্ত্র উচ্চারণ করে নিজেকে ‘বিকাশ পুরুষ’ হিসেবে তুলে ধরুন বা অটলবিহারী বাজপেয়ী হয়ে ওঠার চেষ্টা করুন, গোধরা পরবর্তী দাঙ্গার ভূত এখনও তাঁর পিছু ছাড়েনি। তা ছাড়া, তাঁর নাম উঠলেই ফের মাথাচাড়া দেবে হিন্দুত্বের প্রশ্নটি। মেরুকরণ হবে রাজনীতির। যা এখনই অন্তত চায় না বিজেপির একটা বড় অংশ। তা ছাড়া দল হিসেবেও বিজেপি এখন নিজেদের উগ্র হিন্দুত্বের অবস্থান থেকে দূরে সরাতে চাইছে। আজ রাজনাথের বক্তৃতাতেও এক বারের জন্য রামমন্দির-প্রসঙ্গ ওঠেনি।
এই পরিস্থিতিতে একবারে না এগিয়ে ধাপে ধাপে মোদীকে তুলে ধরার কৌশল নিয়েছেন বিজেপি ও সঙ্ঘ নেতৃত্ব। আগামিকাল বৈঠকের শেষ দিনে কোনও ঘোষণা না হলেও সঙ্ঘ নেতৃত্ব মার্চ মাসের শেষে মোদীকে আরও একধাপ তুলে ধরার কৌশল নিয়েছেন। মোদীকে নির্বাচনী প্রচার কমিটির প্রধান করার প্রস্তাব তো রয়েইছে। তা ছাড়া মার্চে জয়পুরে সঙ্ঘের বৈঠকের পরেই জাতীয় রাজনীতিতে বাড়তি গুরুত্ব দিতে মোদীকে সংসদীয় বোর্ডে আনা নিয়ে আলোচনা চলছে। কিন্তু আডবাণী, সুষমা স্বরাজদের বক্তব্য, সে ক্ষেত্রে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানকেও সংসদীয় বোর্ডে আনা হোক। কারণ, লোকসভা ভোটের আগে মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রীরা নিজেদের রাজ্যে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারলে তাঁরাও তিন বার জয়ের হকদার হবেন। মোদীর নামে ভোট টানলেও শেষ বাজারে বিজেপির ক্ষমতায় আসার পরিস্থিতি এলে অন্য কাউকে প্রধানমন্ত্রী করার ভাবনাও রয়েছে দলের কিছু নেতার মাথায়।
কিন্তু সে সব তো নিছক অঙ্ক আর পরিকল্পনা। বিজেপির বহু নেতাই প্রকাশ্যে মেনে নিচ্ছেন, এখন মোদীই একমাত্র নেতা, যাঁর নামে বিজেপির বাক্সে ভোট পড়তে পারে। পরিষদের বৈঠকের শুরুতেই দলের প্রবীণ নেতা বিজয় গোয়েল বলেন, “মনমোহন সিংহকে এখন আর কেউ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাইছেন না। দেশের বাচ্চারাও চাইছে, নরেন্দ্র মোদীই দেশের প্রধানমন্ত্রী হোন। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হোক বা না হোক।” পরিষদের বৈঠকে অনুরাগ ঠাকুর, উত্তরাখণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রমেশচন্দ্র পোখরিয়াল, অভিনেতা তথা বিজেপি নেতা বিনোদ খন্না সকলেই মোদীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই দেখতে চেয়ে বক্তব্য রেখেছেন। এমনকী দক্ষিণে যে কর্নাটকে প্রথম রাজ্য দখল করেছে বিজেপি, সেখানকার দলত্যাগী নেতা ইয়েদুরাপ্পাও বার্তা পাঠাচ্ছেন, মোদী এলে ফের বিজেপিতে যোগ দেবেন। বিজেপি এখন মোদী-গন্ধে আমোদিত। |
|
|
|
|
|