মন্ত্রী-সান্ত্রী দু’পা দূরে! অপরাধী না-পালিয়ে বরং তাদের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। তাকে হাতকড়া পরানো তো দূর, পাহারাদারেরা চোখ তুলে তাকালই না!
খাস কলকাতার বুকে এমন বিচিত্র ঘটনারই প্রতীক হয়ে রয়েছে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের এই বহুতল। মহাকরণ-লালবাজারের কয়েকশো ফুটের মধ্যে গজিয়ে ওঠা বাড়িটিকে সুপ্রিম কোর্ট ‘বেআইনি’ ঘোষণা করেছে ষোলো বছর হয়ে গেল। চোদ্দোতলা বাড়ির পুরোটা ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়ে আবাসিকদের সরে যাওয়ার জন্য তিন মাসের সময়ও তখন বেঁধে দিয়েছিল শীর্ষ আদালত। কিন্তু খানিকটা ভাঙার পরে সব প্রক্রিয়া সেই যে থমকে যায়, তা আর সচল হয়নি। আপাতত আটতলা ভবনে চুটিয়ে চলছে দোকান-পাট, অফিস। বাস করছে ৫১টি পরিবার। অবৈধ বাড়িতে পুরসভার জলের লাইন আছে, বিদ্যুৎ সংযোগও দস্তুরমতো বহাল।
শ্যাম মার্কেটে আপনাকে স্বাগত।
নন্দরাম মার্কেট, স্টিফেন কোর্ট থেকে শুরু করে হালের সূর্য সেন মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের পরে মহানগরে বেআইনি বাড়ির রমরমা নিয়ে যেখানে মন্ত্রী থেকে মেয়র সরব হয়েছেন, সেখানে পুলিশ-প্রশাসনের নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে খোদ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কী ভাবে টিকে থাকতে হয়, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ কলকাতার প্রাণকেন্দ্রের
এই বাড়ি। পোশাকি ঠিকানা, ১৭৪ নম্বর চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ। বাড়িটি অবৈধ কেন?
কলকাতা পুরসভা সূত্রের খবর: এর কোনও নক্শা পুরসভায় আজ পর্যন্ত জমা পড়েনি। অর্থাৎ সম্পূর্ণ বিনা অনুমোদনে ১৯৭৯ থেকে ধাপে ধাপে মাথা তুলেছিল চোদ্দোতলা বাড়ি। মালিকের নাম শ্যামলাল অগ্রবাল। তাঁর সেই বাজার-বাড়ির নাম হয় শ্যাম মার্কেট, যার প্রতিটি তলের আয়তন পাঁচ হাজার বর্গফুট। বাড়ি পুরো উঠে যাওয়ার পরে পুরসভার টনক নড়ে। বাড়ি ভাঙার পুর-নির্দেশ জারি হয়। মালিক-ভাড়াটিয়ারা কোর্টে যান। সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত মামলা গড়ায়। অবশেষে ১৯৯৬-এর ২০ অগস্ট সুপ্রিম কোর্ট গোটা বাড়ি ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয়। আবাসিকদের অন্যত্র সরতে সময় বরাদ্দ হয় তিন মাস। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ হাতে পেয়ে পুরসভাও উপরের পাঁচটা তলা ভেঙে দেয়। সেখানে তখন কোনও আবাসিক ছিল না।
বাকি আটটা তলা (ন’তলার শুধু দেওয়াল আছে, ছাদ নেই) এখনও টিকে রইল কী করে? |
এমনই অবস্থা শ্যাম মার্কেটের অগ্নি সুরক্ষা ব্যবস্থার। —নিজস্ব চিত্র |
পুর-কর্তাদের কাছে সদুত্তর নেই। তবে পুর-প্রশাসনিক ও স্থানীয় সূত্রের অভিযোগ, ভোটের তাগিদে রাজনীতির কারবারিদের একাংশ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে বাসিন্দাদের পিছনে দাঁড়িয়ে পড়েন। ফলে বাড়ি আর ভাঙা হয়ে ওঠে না। অথচ সুপ্রিম কোর্টের রায় ছিল অত্যন্ত কঠোর। “কোর্ট জানিয়ে দিয়েছিল, দেশের আর কোনও আদালতে এই বাড়ি নিয়ে কোনও মামলা করা চলবে না। তবু কিছু করা যায়নি।” জানাচ্ছেন এক পুর-কর্তা।
এবং অদূর ভবিষ্যতে করা
যাবে, সে ইঙ্গিতও নেই। কারণ, পুর-প্রশাসন যেমন বিষয়টি নিয়ে অজ্ঞতা
প্রকাশ করেছেন, তেমন দল-নির্বিশেষে নেতা-জনপ্রতিনিধিদের বক্তব্যেও কঠোর পদক্ষেপের বার্তা নেই। উল্টে কিছু ক্ষেত্রে তাঁদের গলায় আবাসিকদের প্রতি সহমর্মিতার সুর! কী রকম?
মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ব্যাপারটা তো অনেক পুরনো। কিছুই জানি না!” পুরসভার ডিজি (বিল্ডিং) অনিন্দ্য কারফর্মার বক্তব্যও এক। প্রাক্তন সিপিএম মেয়র বিকাশ ভট্টাচার্যের যুক্তি: “নন্দরাম মার্কেটের মতো ১৭৪, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের বাড়ি ভাঙায় নানা বাধা ছিল।” এলাকার প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ সুধাংশু শীল অবশ্য স্বীকার করছেন, তিনি আবাসিকদের ‘আশ্বাস’ দিয়েছিলেন। “ওখানকার ভাড়াটেরা আমার কাছে এসেছিলেন। সেটা ছিল ১৯৯০ সাল। আর ২০০৪-এ আমি লোকসভা ভোটের প্রার্থী হয়ে ওই বাড়িতে গিয়ে ওঁদের আশ্বাস দিয়েছিলাম, ভোট পেরোলে দেখব। ভোটের পরে আমাকে দিল্লি চলে যেতে হল।’’ বলছেন সুধাংশুবাবু। তবে তাঁর দাবি, বেআইনি অংশ ভাঙতে তিনি কোনও বাধা দেননি। এলাকার বর্তমান কাউন্সিলর জসিমুদ্দিনও সিপিএমের। তিনি জানেন, বাড়িটি আপাদমস্তক বেআইনি এবং ভেঙে ফেলার নির্দেশ রয়েছে। তাঁর মতে, আবাসিকদের আপত্তিতেই নির্দেশ কার্যকর করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে কাউন্সিলর কী করছেন?
জসিমুুদ্দিন শুক্রবার বলেন, “অবৈধ নির্মাণ নিয়ে অন্তত আমার সঙ্গে আবাসিকদের কোনও কথা হয়নি। মূলত বাড়ির নিকাশি-সমস্যা নিয়ে ওঁরা কথা বলেছেন।” এলাকার প্রাক্তন কাউন্সিলর তথা বড়বাজারের কংগ্রেস নেতা আখতার হুসেনের মন্তব্য, “বাড়ির মালিক ও অনেক ভাড়াটের সঙ্গে আমার ভাল সম্পর্ক। আবাসিকেরা যদি জোট বেঁধে বাড়ি ভাঙতে বাধা দেন, আমি কী করব?” আবাসিকদের অনেকে আবার জানাচ্ছেন, বাড়ি যাতে ভাঙা না-পড়ে, স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেস নেতা সঞ্জয় বক্সিও তা ‘দেখার’ আশ্বাস দিয়েছেন। এই দাবি কি ঠিক?
সঞ্জয়বাবু বলেন, “আমি এমন আশ্বাস কাউকে দিইনি। সেই সময়ে সরকার, পুরসভা সবই বামেদের ছিল। তা ছাড়া আমি তো পাশের ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলাম! এর মধ্যে কখনও থাকিনি।” যদিও বাড়ি ভাঙার প্রসঙ্গ তুলতেই সঞ্জয়বাবুর প্রশ্ন, “এত বড় বাড়ি পুরসভা কী ভাবে ভাঙবে?” স্থানীয় বিজেপি নেতা বিনোদ অগ্রবাল কিন্তু সরাসরিই ঘোষণা করেছেন, “আমি বরাবর ওই বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে আছি। ওঁরা এত কাল ধরে রয়েছেন। বাড়ি ভাঙা পড়লে যাবেন কোথায়?”
এ হেন পরিস্থিতিতে প্রবল মানসিক অশান্তিতে রয়েছেন শ্যাম মার্কেটের বর্তমান মালিক সন্তোষ অগ্রবাল। কেন?
শ্যাম অগ্রবালের ছেলে সন্তোষবাবুর আক্ষেপ, “নিয়মিত ভাড়াই তো পাচ্ছি না।” এ দিকে বেআইনি ঘোষিত বাড়ির ভাড়াটেদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক কোনও নালিশও করাও সম্ভব নয়। এই মওকায়
অনেকে বছরের পর বছর বিনা পয়সায় থেকে গিয়েছেন বলে তাঁর অভিযোগ। আবাসিকদের ‘মুখপাত্র’ রবীন্দ্র গুপ্ত আছেন ১৯৮০ থেকে। কী ভাবে আছেন?
রবীন্দ্রবাবুর জবাব, “বাড়িওয়ালা মোটা টাকা সেলামি নিয়ে পাততাড়ি গুটিয়েছেন।” কিন্তু ঢোকার আগে ওঁরা কি জানতেন না যে, বাড়িটা পুরো অবৈধ?
রবীন্দ্রবাবুর ব্যাখ্যা, “ওই সময়ে বাড়ি নেওয়ার আগে কাগজ দেখার এত চল ছিল না।’’
সব দেখেশুনে বিরক্ত বাড়িওয়ালা সন্তোষবাবু বলছেন, “পুরসভা বাড়ি ভেঙে দিলে দিক। আমার আপত্তি নেই।” |