|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
মোমের শিখায় উদ্ভাসিত করুণাদীর্ণ মানবী মুখ |
সম্প্রতি মায়া আর্ট স্পেস-এ অনুষ্ঠিত হল একটি সম্মেলক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
কলকাতায় ললিতকলার আবহমণ্ডলটি এখন খুব ভাল নেই। গত বছর তিনেক যাবৎ ছবির বাজার একেবারে স্তিমিত। অনেক আর্ট গ্যালারিই সংকুচিত করে আনছে তাঁদের কার্যক্রম। ইতিমধ্যে নিষ্ক্রিয়ও হয়ে গেছে অনেকে। এই পরিস্থিতিতেও একটি নতুন আর্ট গ্যালারির সূচনা হল এই কলকাতাতেই। তাতে আশা জাগে শিল্পের আবেগ এখনও হয়তো সম্পূর্ণ নিঃশেষিত নয়।
গ্যালারির নাম ‘মায়া আর্ট স্পেস’। ঠিকানা ৩২৯ শান্তি পল্লি, রাজডাঙা, কলকাতা-৭০০১০৭। মধুছন্দা সেন পরিকল্পিত এই ‘আর্ট স্পেস’-এর প্রথম প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল সম্প্রতি। কলকাতা ও বাংলার ২৩জন নামী শিল্পীর ছবি ও ভাস্কর্য নিয়ে আয়োজিত এই সম্মেলকের শিরোনাম ‘স্পেস উইদিন স্পেস’। ছিমছাম প্রদর্শনী। বিপণনের কথা যে একেবারে মনে রাখা হয়নি নির্বাচনের ক্ষেত্রে, তা নয়। প্রখ্যাত শিল্পীদের আকারে ছোট, একটু সুষমাময়, মিষ্টি ধরনের কাজ বেছে নেওয়া হয়েছে। ক্লাসিক ও রোম্যান্টিক— এই দু’টি ধারায় যদি ভাগ করা হয় সমগ্র শিল্প প্রবাহকে, তা হলে বলা যায় এখানে ‘ক্লাসিক’-এরই প্রাধান্য।
প্রদর্শনীর প্রবীণতম এবং ১৯৪০-এর দশকের একমাত্র শিল্পী সোমনাথ হোর। দু’টি ড্রয়িংধর্মী ছবি ছিল তাঁর ১৯৭৮ ও ১৯৮১তে করা। প্রথমটি লিথোগ্রাফ। জীবনে পরিব্যাপ্ত গভীর ‘ক্ষত’ থেকেই তিনি সৌন্দর্য বের করে আনেন। লিথোগ্রাফটিতে ক্ষুধার্ত কয়েকটি শিশু দাঁড়িয়ে আছে সারিবদ্ধ ভাবে। যেন এই দেশেরই প্রতীক। দ্বিতীয় ছবিটিতে ক্ষুধাকে নিষ্কাশিত করে শিল্পী এক মরমি সৌন্দর্যকে উদ্ভাসিত করতে চেয়েছেন।
১৯৬০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন প্রকাশ কর্মকার, রবীন মণ্ডল, সনৎ কর, গণেশ হালুই, সুহাস রায়, লালুপ্রসাদ সাউ, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, যোগেন চৌধুরী ও সুনীল দাস। তাঁদের ছবি আমাদের বুঝতে সাহায্য করে, কেমন করে ঐতিহ্য ও আধুনিকতা, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন থেকে তাঁরা বের করে এনেছেন কালচেতনার আত্মপরিচয়। |
|
শিল্পী: আদিত্য বসাক |
রবীন, প্রকাশ, সনৎ ও যোগেনের ছবিতে আমরা পাই অন্ধকার ভাঙা আলো। ক্ষয়িত জীবনের বাস্তবতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চেতনা ছিল এক সময় তাঁদের সৃজনের উৎস। সেই প্রতিবাদী-রোম্যান্টিকতা থেকেই এখন তাঁরা বের করে আনছেন ধ্রুপদী স্থৈর্য। সুনীল দাস মুগ্ধ করেছেন তাঁর ‘হেড’ শীর্ষক মিশ্র মাধ্যমের ভাস্কর্যটিতে। বাকি চারজনের ছবিতে অনুভব করা যায় অস্তিতার আলোর প্রতিফলন। প্রকরণের শুদ্ধতা ও আঙ্গিকের বৈদগ্ধে উজ্জ্বল তাঁদের রচনাগুলি।
১৯৭০-এর দশকের একমাত্র প্রতিনিধি শুভাপ্রসন্ন। তাঁর সুপরিচিত প্যাঁচার রূপারোপটি রয়েছে এই প্রদর্শনীতে। ক্যানভাসের উপর তেলরং, অ্যাক্রিলিক ও চারকোলে আঁকা। আদিমতাসম্পৃক্ত কুটিল এক রহস্যময়তা যেন সংহত হয়ে থাকে এই নিশাচরের দৃষ্টিতে, পরোক্ষে এই সময়কে যা কশাঘাত করে।
আশির শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন আদিত্য বসাক, সমীর আইচ ও সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়। আদিত্য গভীর অনুভবে এই সময়ের তমসাকে উদ্ঘাটিত করেছেন। প্রজ্জ্বলিত মোমের শিখায় উদ্ভাসিত করুণাদীর্ণ মানবী মুখটি খুবই গভীর রচনা। নিপুণ স্বাভাবিকতায় আঁকা সুব্রত-র মানবী মুখগুলি সুখ ও পরিতৃপ্তির প্রতীক। রূপভাবনার উন্মীলনে দীপ্ত সমীরের ‘মেটামরফোসিস’।
তরুণতর প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে অতীন বসাকের টেম্পারায় আঁকা ‘দেবী’তে অনুভূত হয় ষাটের দশকের প্রতিধ্বনি। পার্থ দাশগুপ্তের প্রজ্বলিত বাতির দিকে ধেয়ে আসা পতঙ্গের রূপারোপটিও তাই। এই মরমি বোধই স্বকীয়তায় উদ্ভাসিত হয়েছে তাঁর ‘মায়া’ শীর্ষক ছবিটিতে। জলরঙে প্রশ্নাতীত দক্ষতার পরিচয় রয়েছে প্রদীপ মৈত্রের ‘ইনটেরিয়র’ শীর্ষক ছবি দু’টিতে। সনাতন দিন্দার ‘যুগপুরুষ’ অসামান্য দক্ষতায় ধ্যানমগ্ন চেতনার প্রতীক হয়ে ওঠে। স্বাভাবিকতায় অত্যন্ত দক্ষ প্রসেনজিৎ সেনগুপ্ত প্রতিফলিত করেছেন অন্তর্লোকের বিষণ্ণ তন্ময়তা।
ভাস্কর্যে নিরঞ্জন প্রধানের দু’টি ব্রোঞ্জ ‘গোট’ ও ‘মিউজিসিয়ান’-এ তাঁর পরিচিত রূপভঙ্গিরই ঋদ্ধ প্রকাশ। প্রকৃতি-প্রেম ও ধ্রুপদী সুরের প্রতীক এই দু’টি কাজ। সঙ্গীতকে বিষয় করেছেন বিমল কুণ্ডু তাঁর ব্রোঞ্জে। ঘনকবাদী অবয়ব-সংস্থানে রূপ পেয়েছে ধ্রুপদী তন্ময়তা। গোপীনাথ রায়ের ব্রোঞ্জ ‘রাইডার’ প্রথাবদ্ধ রচনা। সিরামিকসের নিসর্গটিতে ধরা পড়ে তাঁর নিজস্বতার পরিসর। |
|
|
|
|
|