প্রবন্ধ...
সেই ট্র্যাডিশন আর চলল না, এটাই স্বস্তি
ড় ছবিটা পরিষ্কার। নির্বাচনের আগে এটাই শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। কাজেই, খরচ বাড়ানোর জন্য ‘জনমোহিনী’ চাপ ছিলই। একটা বিপরীত চাপও ছিল, ঘাটতি কমানোর। প্রত্যেক বাজেট বক্তৃতাতেই যেমনটা দস্তুর, এই বক্তৃতাতেও তেমনই বহু ঘোষণা ছিল হরেক প্রকল্প এবং আপাত- ব্যয়বৃদ্ধির ঘোষণা। কিন্তু, চিদম্বরম এই অর্থবর্ষে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণকে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৫.২ শতাংশে বেঁধে ফেলেছেন। আগামী বছর ৪.৮ শতাংশের মধ্যে রাখবেন, এমন প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। ভাষণে বললেন, তিনি নিজের জন্য কিছু লক্ষ্মণরেখা এঁকে নিয়েছেন। রাজকোষ ঘাটতির ক্ষেত্রে সেই রেখার বাইরে তিনি পা ফেলবেন না।
তাঁর কথা এবং কাজের সাযুজ্য খুঁজতে গেলে কতকগুলো জিনিসের দিকে তাকাতে হবে। প্রথমত, তিনি বেশ কিছু যোজনা-বহির্ভূত খরচ, যেমন বিভিন্ন ঋণের ওপর সুদ, প্রতিরক্ষা খাতে খরচ বা পেনশন বিশেষ বাড়াননি। উল্লেখ্য, ২০১২-১৩ সালে মোট ভর্তুকির পরিমাণ যেখানে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ২.৫ শতাংশের একটু ওপরে ছিল, চিদম্বরম সেখানে ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষের জন্য ভর্তুকির মাত্রা স্থির করেছেন অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের দুই শতাংশ। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন অর্থমন্ত্রী বলছেন তো, শেষ পর্যন্ত পারবেন কি?
দ্বিতীয়ত, অর্থমন্ত্রী কয়েকটি ক্ষেত্রে যোজনা-বহির্ভূত মূলধনী ব্যয় বাড়িয়েছেন, বিশেষত প্রতিরক্ষায়। ২০১২-১৩ সালে এই খাতে যে টাকা ব্যয় করা হয়েছে, তার সঙ্গে তুলনা করলে তো বটেই, এমনকী গত বাজেটে যে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল, তার সঙ্গে তুলনাতেও এই বছরের বৃদ্ধি নেহাত ফেলনা নয়। এই খাতে গত বছরের বাজেট বরাদ্দের তুলনায় এই বছর বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে নয় শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হারের কথা মাথায় রাখলেও বলতেই হবে, বরাদ্দ যথেষ্ট বেড়েছে।
এই সূত্রেই তৃতীয় কথাটিতে আসা যায়। এ বাজেট বক্তৃতায় দেখা গেল, চিদম্বরম কোন খাতে কত টাকা বাড়িয়েছেন, তা বোঝাতে এই বছরের বাজেট বরাদ্দের সঙ্গে তুলনা করছেন ২০১২-১৩ সালে আসলে যে খরচ হয়েছে, তার সঙ্গে। এর একটা কারণ আছে। গত বছরের বাজেটে যে খাতে যত টাকা বরাদ্দ হয়েছিল, বহু ক্ষেত্রেই আসলে তার তুলনায় কম টাকা খরচ হয়েছে। ফলে, গত বছরের বাজেট বরাদ্দের সঙ্গে এ বারের বাজেট বরাদ্দের তুলনা করলে দেখা যাবে, আসলে অর্থমন্ত্রী যতটা দেখাতে চাইছেন, বরাদ্দ ততটা বাড়েনি। তিনি যে লক্ষ্মণরেখার কথা বলেছেন, এ বছর তা উল্লঙ্ঘনের প্রয়োজন হয়নি, কারণ যোজনা ব্যয় অনেকটা ছেঁটে ফেলা হয়েছে। আগামী বছরেও কি তিনি এই কাজটি করতে পারবেন, নাকি সাপ্লিমেন্টারি বাজেটের ধাক্কায় তাঁর সাধের সংখ্যাগুলো সব এলোমেলো হয়ে যাবে?
চতুর্থত, চিদম্বরমের যাবতীয় হিসেব দাঁড়িয়ে আছে একটি অনুমানের ওপর টাকার অঙ্কে হিসেব করলে ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ১৩.৪ শতাংশ। এটা হল নমিনাল গ্রোথ রেট বা বৃদ্ধির আপাত হার। চিদম্বরম তাঁর বাজেট-ভাষণে বলেছেন, ‘সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিকাল অফিস হিসেব করেছে, চলতি বছরে ভারতীয় অর্থনীতির প্রকৃত বৃদ্ধির হার দাঁড়াবে পাঁচ শতাংশ। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হিসেব, এই হার হবে সাড়ে পাঁচ শতাংশ।’ অর্থমন্ত্রী বাজেটের আগের দিন যে অর্থনৈতিক সমীক্ষা প্রকাশ করেছেন, তাতে বলা হয়েছে, ‘২০১০-১১ সালের চতুর্থ ত্রৈমাসিক থেকে ২০১১-১২ অর্থবর্ষের চতুর্থ ত্রৈমাসিক পর্যন্ত টানা পাঁচটি ত্রৈমাসিকে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের বৃদ্ধির হার কমেছে। বর্তমান অর্থবর্ষের প্রথম ছ’মাসে বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৫.৪ শতাংশ এবং সি এস ও-র অগ্রিম অনুমান হল, এই অর্থবর্ষে বৃদ্ধির হার দাঁড়াবে পাঁচ শতাংশে।’ অর্থাৎ, ২০১২-১৩ অর্থবর্ষের শেষ ছ’মাসে অর্থনীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে মাত্র ৪.৬ শতাংশ হারে।
অর্থনৈতিক সমীক্ষা অবশ্য অনুমান করেছেন, ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষে ভারতীয় অর্থনীতি ৬.১ শতাংশ থেকে ৬.৭ শতাংশের মধ্যে কোনও হারে বৃদ্ধি পাবে। অর্থনীতির বৃদ্ধির হার কেন এমন নুয়ে পড়েছে, তার ব্যাখ্যা অর্থনৈতিক সমীক্ষায় রয়েছে। কিন্তু কোন যুক্তিতে তাঁরা আশা করছেন যে বৃদ্ধির হার ৪.৬ শতাংশ থেকে সটান ৬.৭ শতাংশে পৌঁছে যাবে, তার কোনও ব্যাখ্যা সমীক্ষায় নেই। সমীক্ষায় যে সাম্প্রতিক সংস্কার কর্মসূচির কথা বলা হয়েছে, সেই যুক্তিটি অন্তত খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আমি এ কথা বলতে চাইছি না যে ভারতীয় অর্থনীতি এই ৪.৬ শতাংশ বৃদ্ধির হারেই আটকে থাকবে। এই হার অবশ্যই বাড়বে। কিন্তু কতখানি? সাড়ে পাঁচ শতাংশ? বড় জোর ছয় শতাংশ? কিন্তু তা হলেও, যদি সাত শতাংশ মূল্যস্ফীতির হার ধরে নেওয়া যায়, তবে বৃদ্ধির আপাত হার আটকে যাচ্ছে ১৩ শতাংশে, ১৩.৪ শতাংশের অঙ্কটি অধরাই থাকছে। অর্থাৎ, চিদম্বরম ঘাটতির যে হিসেব দেখিয়েছেন, তাতে গোলমাল থেকে যাচ্ছে। ঘাটতির পরিমাণ তিনি যা ধরছেন, তা যদি সত্যিই হয়ও, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন তিনি যতখানি হিসেব কষছেন, সেটা তার চেয়ে কম হবে, ফলে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের অনুপাতে ঘাটতির পরিমাণ তাঁর হিসেবের চেয়ে বাড়বে বলেই আশঙ্কা হচ্ছে।
চিদম্বরম তাঁর বাজেট-বক্তৃতায় বলেছেন, বৃদ্ধির উচ্চতর কক্ষপথে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন এবং ভোগব্যয় ও বেসরকারি বিনিয়োগ যাতে বাড়ে, তার ব্যবস্থা করাও দরকার। এই কথাটির যৌক্তিকতা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু এই বাজেট সেই কাজটি করবে, এমন প্রত্যাশা করা অযৌক্তিক। এই কাজটি অনেক উপায়ে করা যায়, বাজেট একটা উপায়মাত্র। আর্থিক বৃদ্ধি এবং বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য যে ধাক্কা প্রয়োজন, তা অন্য জায়গা থেকে আসে। কাজেই, এই বাজেটকে যেমন অহেতুক খরচ করার গড্ডলিকা প্রবাহে গা না ভাসানোর জন্য তারিফ করা বাঞ্ছনীয়, তেমনই এতে উল্লিখিত অঙ্কগুলি নিয়ে কিঞ্চিৎ সতর্ক থাকাও বিধেয়। যেমন, যদিও এই বাজেটে কোথাও স্পষ্ট করে বলা হয়নি যে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম এবং টাকার মূল্য কম-বেশি স্থির থাকবে, তবুও প্রচ্ছন্ন ভাবে এই অনুমানটি বেশ রকম উপস্থিত। এই অনুমান একটা বিলাসিতা। সেই বিলাসিতার অধিকার অর্থমন্ত্রীর নেই।
তবে দেশের আয় যথেষ্ট বাড়লে তবেই রাজস্বও যথেষ্ট বাড়বে এই সত্যের একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে। যাঁরা বলেন যে, জিডিপি’র গ্রোথ রেট নিয়ে এত মাথা ঘামানোর দরকার নেই, মানুষের ভাল করাটাই আসল কথা, তাঁরা এই প্রাথমিক সত্যটা ভুলে যান। ঘটনা হল, আয় যথেষ্ট না বাড়লে রাজস্ব বাড়ে না, রাজস্ব না বাড়লে সরকারের পক্ষে সামাজিক কল্যাণের জন্য যথেষ্ট ব্যয় চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। সুতরাং আর সব কারণ ছেড়ে দিলেও, কেবল সামাজিক ব্যয় বাড়ানোর জন্যও জিডিপি’র যথেষ্ট বৃদ্ধি জরুরি। আশার কথা, চিদম্বরম এটা বোঝেন।

অর্থনীতিবিদ, দিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চে কর্মরত


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.