১৯৯৭ সালের অর্থমন্ত্রী পালনিয়াপ্পন চিদম্বরম ‘স্বপ্নের বাজেট’ পেশ করিয়াছিলেন। ২০১৩ সালের অর্থমন্ত্রী যে বাজেটটি পেশ করিলেন, তাহাকে নির্দ্বিধায় ‘বাস্তবের বাজেট’ আখ্যা দেওয়া যাইতে পারে। ২০১৩ সালের বাস্তব। সেই বাস্তবে লাগামহীন রাজকোষ ঘাটতির দুশ্চিন্তা আছে, মূল্যস্ফীতির আতঙ্ক আছে, চলতি খাতে ক্রমবর্ধমান আমদানি ও মন্দগতি রফতানিজনিত তীব্র সমস্যা আছে। সর্বোপরি আছে আর্থিক বৃদ্ধির হারের গতিভঙ্গের ভীতি। এই বাস্তবের সহিত ১৯৯৭-এর স্বপ্নের মিল নাই। চিদম্বরম ২০১৩ সালের বাস্তব মাথায় রাখিয়াই বাজেট পেশ করিয়াছেন। তিনি জানাইয়াছেন, আর্থিক বৃদ্ধি সুনিশ্চিত করাই তাঁহার সর্বাগ্রগণ্য লক্ষ্য। তাহার দুইটি দিক আছে। প্রথমটি, যথার্থ পরিবেশ সৃষ্টি করা। অর্থমন্ত্রী চলতি খাতে ঘাটতি কমাইতে উদ্যোগ করিয়াছেন। আগামী বৎসর রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ ৪.৮ শতাংশে বাঁধিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুত হইয়াছেন। এক দিকে ব্যয় হ্রাস আর অন্য দিকে রাজস্ব বৃদ্ধি— সুস্থায়ী অর্থনীতির একেবারে গোড়ার কথাটি তিনি স্মরণ করিয়াছেন। রেল বাজেট এবং সাধারণ বাজেটকে একই সঙ্গে দেখিলে আশা জাগে, হয়তো এত দিনে রাজনীতিকরা বুঝিয়াছেন— বাজেটের সহিত জনমোহিনী রাজনীতি মিশাইয়া ফেলা স্বাস্থ্যকর নহে।
আর্থিক বৃদ্ধির পথ সুগম করিবার দ্বিতীয় দিক, বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ যাহাতে আসে, তাহার চেষ্টা করা হইয়াছে। কিন্তু অর্থমন্ত্রীও জানেন, সেই ভরসায় ৬.৭ শতাংশ বৃদ্ধির অঙ্ক কষা মুশকিল। তাহার জন্য দেশজ বিনিয়োগ চাই। রাজকোষ ঘাটতির হারে লাগাম টানিলে মূল্যস্ফীতি যদি নিয়ন্ত্রণে আসে, একমাত্র তখনই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার কমাইবার কথা ভাবিতে পারে। অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে অর্থমন্ত্রী কারখানা এবং যন্ত্রপাতিতে ১০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ ভাতা দেওয়ার কথা ঘোষণা করিয়াছেন। আশা করা যায়, এই সিদ্ধান্তে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়িবে। অন্য দিকে, বার্ষিক করযোগ্য আয় ১০ কোটি টাকা বা তাহার বেশি, এমন বাণিজ্যিক সংস্থার উপর পাঁচ শতাংশের পরিবর্তে দশ শতাংশ সারচার্জ আরোপ করার সিদ্ধান্তটি যেহেতু মাত্র এক বৎসরের জন্য, তাহা নেতিবাচক প্রভাব ফেলিবে না।
আর্থিক বৃদ্ধির হার কী হইবে, তাহার উপর চিদম্বরমের যাবতীয় হিসাব দাঁড়াইয়া আছে। স্মরণ করাইয়া দেওয়া যাক, গত বৎসর তাঁহার পূর্বসূরি অনুমান করিয়াছিলেন, ২০১২-১৩ অর্থবর্ষে আর্থিক বৃদ্ধির হার ৭.৬ শতাংশ হইবে। হইয়াছে পাঁচ শতাংশ। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাইবার দায়িত্ব অর্থমন্ত্রীর। অন্য দিকে, তিনি সম্ভবত কর আদায়ের প্রক্রিয়ার সংস্কারসাধনের মাধ্যমে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের কথা ভাবিতেছেন। ভাবনাটি নিঃসন্দেহে সদর্থক, কিন্তু সেই ভরসায় রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ স্থির করা বিপজ্জনক প্রতিপন্ন হইতে পারে। আরও একটি চিন্তার কারণ, করবহির্ভূত রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির পথ কেমন হইবে, সেই ছবিটি অর্থমন্ত্রী স্পষ্ট করিতে পারেন নাই। অর্থনীতি যদি ঝিমাইয়া থাকে, তবে স্পেকট্রাম নিলামই হউক বা এফ এম রেডিয়োর লাইসেন্স— কোনও খাতেই তেমন আয় হইবার আশা কম।
অর্থমন্ত্রীর সম্মুখে অবশ্য আরও বড় আশঙ্কার কারণ রহিয়াছে। তাহার নাম লোকসভা নির্বাচন। তিনি তাঁহার ভাষণে তাঁহার পূর্বসূরিকে বেশ এক হাত লইয়াছেন, কারণ তিনি তাঁহার বাজেটে যোজনা-বহির্ভূত ব্যয়ের যে অনুমান করিয়াছিলেন, বাস্তবে ব্যয় তাহার ঢের বেশি হইয়াছে। সেই দায়টি সম্পূর্ণত প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ঘাড়ে চালান করিলে অন্যায় হইবে— ভর্তুকিতে হাত খুলিবার সিদ্ধান্ত মনমোহন সিংহ বা সনিয়া গাঁধীর সম্মতি ব্যতিরেকে হয় নাই। চিদম্বরমকেও তাঁহাদের সহিতই ঘর করিতে হয়। অলমিতিবিস্তারেণ। তাহার উপর আছে আন্তর্জাতিক তেলের বাজারের অনিশ্চয়তা। ২০০৮-০৯ সালে মোট ভর্তুকির মাত্র ২.২ শতাংশ পেট্রোলিয়াম খাতে যাইত। ২০১২-১৩ সালের বাজেটে তাহা ছিল প্রায় ২৩ শতাংশ। সরকার কি এখনও ভর্তুকি দিবে? চিদম্বরমের এই বাজেটটি কতখানি সফল হইবে, তাহা এই প্রশ্নগুলির উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত বলা মুশকিল। |