ঘাটতি বিপুল, দাওয়াই কড়া
র্থনীতির আসল অসুখটা হল ঘাটতি। বিশেষ করে চলতি খাতে বাণিজ্যিক লেনদেনের ঘাটতি। সেই রোগ সারাতে আজ বাজেটে দাওয়াই দিলেন চিদম্বরম।
সামাজিক প্রকল্পে খরচ বেড়ে যাওয়া ও মন্দার বাজারে রাজস্ব আদায়ে টান পড়ায় বেলাগাম হয়ে পড়েছিল রাজকোষ ঘাটতি (ফিসকাল ডেফিসিট)। কিন্তু তার থেকেও গভীর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বৈদেশিক বাণিজ্যে চলতি খাতে ঘাটতি (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট)। সোজা কথায়, আমদানি আর রফতানির ফারাক। ফারাকটা বেড়েই চলেছে। যার জেরে দেশের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারে টান পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যা কেন্দ্রের প্রাক্তন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা শঙ্কর আচার্যের মতো অনেককেই ১৯৯০ সালের সঙ্কটের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। আজ কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী তাই বাজেটের শুরুতেই স্বীকার করে নেন, “লেনদেনের ঘাটতিটাই আমার কাছে (রাজকোষ ঘাটতির চেয়েও) বেশি দুশ্চিন্তার কারণ। এই ঘাটতি মেটাতে ৭৫০০ কোটি ডলার প্রয়োজন।” ঘাটতির সেই অসুখ সারাতেই বাজেটে বহুমুখী দাওয়াই দিয়েছেন তিনি।
লেনদেনের মাত্রাছাড়া ঘাটতির মূল কারণ ছিল, বিদেশ থেকে পেট্রোলিয়াম, কয়লা ও সোনা আমদানির জন্য বিদেশি মুদ্রার বিপুল ব্যয়। আমেরিকা-ইউরোপে মন্দার জন্য রফতানিতেও টান পড়েছে। ফলে বিদেশি মুদ্রার আয় কমেছে। বিদেশ থেকে ভারতের বাজারে লগ্নি কমে আসায় কমেছে বিদেশি মুদ্রার আমদানি। পাশাপাশি রাজকোষ ঘাটতি পাঁচ শতাংশ ছাড়িয়েছে। ঘাটতি কমাতে তাই পেট্রোপণ্যে ভর্তুকি প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে। এর পিছনে দু’টি লক্ষ্য রয়েছে। ডিজেল-রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি কমালে রাজকোষ ঘাটতি কমবে। আবার ডিজেলের দাম বাড়ায় কমবে চাহিদা। যার ধাক্কায় ধীরে ধীরে অশোধিত তেল আমদানির খরচও কমবে, অন্তত কম বাড়বে। একই উদ্দেশ্যে আজ ডিজেল-চালিত এসইউভি গাড়ির উপরে বাড়তি কর চাপিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। অন্য দিকে, সোনা কেনার বদলে লোকে যাতে মিউচ্যুয়াল ফান্ড বা ন্যাশনাল সিকিউরিটি সার্টিফিকেটে টাকা রাখেন, তার জন্য এগুলি আরও আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা করেছেন তিনি। জানিয়েছেন, রফতানি ক্ষেত্রকে চাঙ্গা করতে মার্চে নতুন নীতি ঘোষণা হবে।
অর্থমন্ত্রী স্পষ্ট বলেছেন, শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানো এখন বড় চ্যালেঞ্জ। গত কাল প্রকাশিত ২০১২-১৩ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা রঘুরামন রাজনও লিখেছেন, জাতীয় আয় বাড়ানোর জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সুদের হার বেড়ে গেলে বিনিয়োগ ধাক্কা খাবে। আমদানি-রফতানির ঘাটতি যদি নাগালের বাইরে চলে যায়, তা হলে ভারতের ক্রেডিট রেটিং পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে ঋণ নিতে গেলে অনেক চড়া হারে সুদ দিতে হবে। এই কারণেই বাণিজ্যিক ঘাটতি কম রাখাটা বেশি জরুরি।
বাণিজ্যিক ঘাটতির পাশাপাশি মাত্রাছাড়া রাজকোষ ঘাটতির জন্যও চিদম্বরমের হাত-পা বাঁধা ছিল। যতটা সম্ভব আয় বাড়িয়ে এবং বিপুল পরিমাণে খরচ কমিয়ে এ বছর রাজকোষ ঘাটতি ৫.২ শতাংশে বেঁধে রেখেছেন তিনি। বলেছেন, আগামী বছর ঘাটতি আরও কমিয়ে ৪.৮%-এ নামিয়ে আনবেন। রাজস্ব ঘাটতিও ৩.৯% থেকে ৩.৩%-এ নামিয়ে আনার কথা ঘোষণা হয়েছে। প্রণবের আমলে, বিশেষ করে গত বাজেটে, রাজকোষ ঘাটতি লাগামছাড়া হয়ে গিয়েছিল। ধাপে ধাপে ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যমাত্রা থেকেও সরে গিয়েছিলেন প্রণব। চিদম্বরম কিন্তু আর্থিক শৃঙ্খলার পথে ফিরেছেন।


ভোট ও অর্থনীতি এই দু’য়ের মধ্যে ভারসাম্য রেখে আজ এগোনোর চেষ্টা করেছেন চিদম্বরম। লোকসভা নির্বাচনের আগের বছরের বাজেট মানেই ঢালাও জনমোহিনী প্রকল্প, আয়কর ছাড়, বিপুল খরচের বন্যা ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে এটাই চিরপরিচিত ছবি। এ বারের বাজেট তার ব্যতিক্রম। যেমনটা রেল বাজেটের ক্ষেত্রেও হয়েছে। চিদম্বরম আর্থিক বৃদ্ধিকেই প্রধান লক্ষ্য করেছেন। সেই লক্ষ্যপূরণে নতুন লগ্নি টানার জন্য বিনিয়োগ-ভাতা ঘোষণা করেছেন। এ ছাড়াও পরিকাঠামো, আবাসন, উৎপাদন, বিদ্যুৎ, ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পের জন্য আলাদা ভাবে নজর দিয়েছেন।
আর্থিক সমীক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, আগামী আর্থিক বছরে বৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের অনেকটাই উপরে যাবে। তার পরের বছর যা ৭ শতাংশ ছোঁবে। তার সঙ্গে তাল রেখে রাজস্ব আয়ও বাড়বে বলে আশা করছেন তিনি। বিলগ্নিকরণ থেকেও ৪০ হাজার কোটি টাকা তোলার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছেন। বাজেট পেশের পরে চিদম্বরম বলেন, “এ বছর আর্থিক বৃদ্ধি ৫ শতাংশ হলেও রাজস্ব আয় বাড়ছে। কাজেই বৃদ্ধি যখন ৬ শতাংশের উপরে যাবে, তখনও রাজস্ব আয় একই থাকবে, এমন ভাবার কারণ নেই। বৃদ্ধির হার থেকেই সকলের জন্য স্থায়ী উন্নয়ন সম্ভব। এটাই আমাদের মূল মন্ত্র।”
ভোটের কথা মাথায় রেখে কিছু নতুন প্রতিশ্রুতি দিতেই হয়। তাই মহিলা, তফসিলি জাতি-উপজাতি, আদিবাসী, দারিদ্রসীমার নীচের মানুষ, সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের কথা মাথায় রেখে নতুন কিছু ঘোষণা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী এবং সনিয়া গাঁধীর দূত হয়ে মহিলা, চাকরিপ্রার্থী তরুণ, দরিদ্র শ্রেণির পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু এ সবের জন্য এমন কিছু অর্থ বরাদ্দ করেননি, যাতে অপচয়ের অভিযোগ ওঠে। বরং ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সামাজিক সুরক্ষা ও গ্রামোন্নয়নের মতো যাবতীয় সামাজিক প্রকল্পের খরচে শক্ত হাতে রাশ টেনেছেন। একশো দিনের কাজ, খাদ্যে ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ বিশেষ বাড়াননি। ইন্দিরা আবাস বা প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় এ বছর প্রচুর টাকা বাঁচিয়েছেন। শেষবেলায় তাড়াহুড়ো করে টাকা খরচ করতে দেননি।
এখানেই থামছেন না সংস্কারপন্থী চিদম্বরম। তাঁর আশ্বাস, “জবাবি বক্তৃতা ও অর্থ বিল পাশের সময় আরও কিছু সিদ্ধান্ত ঘোষণা করব।” আর্থিক বৃদ্ধির পথে ফেরার লক্ষ্যে স্থির অর্থমন্ত্রী তামিল কবি তিরুভাল্লুভারকেই উদ্ধৃত করেছেন, ‘‘নিজের চোখে যা ঠিক বলে মনে হয়, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও সচেতন ভাবে সেটাই করা উচিত।”

ঘাটতির অভিধান
রাজকোষ: আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি
বাণিজ্য*: রফতানির চেয়ে আমদানি বেশি
অসুখ: বাণিজ্য ঘাটতি জাতীয় আয়ের আড়াই শতাংশের মধ্যে থাকা উচিত। এখন প্রায় ৫ শতাংশ
* বাণিজ্য: পণ্য ও পরিষেবা দু’টোই


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.