তারাবাজি
বসন্ত বিলাপ
মন বসন্ত দিনে বাড়ি ফেরো মাংস কিনে!... ফাল্গুন-চৈত্রের গরমে আজকাল বাংলা ব্যান্ডের গান ছাড়া কী বা ভাবা যায়!
বসন্ত ঋতু? আপাতত উধাও! সকাল দশটার পর থেকেই গরমে চাঁদি ফেটে চৌচির। পরমা আইল্যান্ড থেকে গড়িয়া, সর্বত্র আধখ্যাঁচড়া দানবীয় সব থাম্বা। কোকিলের কুহুধ্বনি? দূর মশাই! গাছের পাতায় পুরু ধুলো। পাতিকাক, চড়াই পাখিরাও শহর ছেড়ে হাওয়া। এর পরেও বলতে হবে ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে!’ রবীন্দ্রনাথ বরং ট্রাফিক সিগন্যালেই নির্বাসন ভোগ করুন!
কবিদের মন ছাড়া কোথায়ই বা বসন্ত আছে? আবহাওয়া-বিজ্ঞানে ঋতুটির অস্তিত্বই নেই। “বৈজ্ঞানিক মতে, আমাদের এখানে চারটে ঋতু। বর্ষা, বর্ষা-পরবর্তী, শীত এবং গ্রীষ্ম,” জানালেন আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ। হাওয়া অফিসে শরৎকালের স্বীকৃতি থাকলেও বসন্ত নিরুদ্দেশ!
নিরুদ্দেশ, কেন না, বসন্ত যৌবনের চেয়েও ক্ষণস্থায়ী। “শীত চলে যাচ্ছে, উত্তুরে বাতাসের ঝাপ্টা আর নেই, দক্ষিণ দিক থেকে বাতাস বইতে শুরু করেছে, এই সময়টাকেই বসন্ত বলতে পারেন,” বলছিলেন গোকুলবাবু। হিমালয় থেকে আসা উত্তুরে বাতাসে জলীয় বাষ্প কম, শরীর থেকেও সে জল শুষে নিতে পারে। ফলে শীতকালে ঠোঁট ফাটে, ত্বক রুক্ষ হয়ে যায়। আর, সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আসা দখিনা বাতাসে জলীয় বাষ্প থাকে, ফলে আরাম বোধ হয়। এই দখিনা বাতাসকেই সংস্কৃতে ‘মলয় সমীরণ’ বলে।
হু হু বাতাসটা আজও টের পাওয়া যায় লং ড্রাইভে গেলে। কলকাতা ছেড়ে হাইওয়েতে পড়লেই দু’পাশে সবুজ খেত, বৃক্ষশাখায় কিশলয়। “কলকাতা ছাড়িয়ে গ্রামের দিকে গেলেই বসন্তের অনুভূতি পাবেন। নগরায়ণ হয়নি, ফলে বাতাসের চলাচল বোঝা যায়,” বলছিলেন গোকুলবাবু। মার্চ-এপ্রিলে ডুয়ার্স বা সিকিমের গ্রামে গেলেও বসন্তের খোঁজ মিলবে। শাখায় শাখায় উদ্ধত, লাল রডোডেনড্রনগুচ্ছ। বসন্তের ঠিকানা আজ শহর থেকে দূরে!

‘সিলসিলা’ ছবির ‘রং বরসে’ গানের দৃশ্যে অমিতাভ-রেখা
উৎসবপ্রিয় বাঙালির অবশ্য বসন্ত নিয়ে হামলে-পড়া আদিখ্যেতার শেষ নেই। দোলের নামই দিয়েছে সে ‘বসন্তোৎসব’। দোল ছাড়াও এই ষষ্ঠ ঋতুতে সরস্বতী পুজো, ভ্যালেনটাইন’স ডে, শিবরাত্রি অনেক কিছুই ক্যালেন্ডারে জায়গা করে নেয়। ফাল্গুন-চৈত্রের সব চেয়ে বড় শহুরে উৎসবটি অবশ্য ক্যালেন্ডারে লেখা থাকে না। গড়িয়াহাট, হাতিবাগানের ফুটপাথ থেকে বড় বড় দোকানে এবং শপিং মলে তখন ‘চৈত্র সেল’-এর দামামা। সোয়েটার, জ্যাকেট, ব্লেজারকে এক বছরের জন্য নির্বাসন দিয়ে হাল্কা পোশাকে ফিরে আসা।
পোশাকই বসন্তের অন্যতম দিকচিহ্ন। মধ্যবিত্তের ‘চৈত্র সেল’ থেকে উচ্চবর্গের ফ্যাশন ডিজাইনারদের ‘স্প্রিং কালেকশন’, সর্বত্র তার হাতছানি। অগ্নিমিত্রা পলের বসন্তসম্ভারে এ বার মধুবনী ছবি। “খাদি আর মটকার তৈরি গাউনে মধুবনী পেন্টিং। ঢাকাই আর নেট কাপড় জুড়ে যে শাড়ি তৈরি করেছি, তাতেও মধুবনী। সুতি আর মটকায় তৈরি করেছি গ্রে, পেস্তা সবুজ রঙের হাল্কা জ্যাকেট,” বলছিলেন তিনি।
অগ্নিমিত্রা বসন্তকে খুঁজেছেন মধুবনী ছবিতে। শহরের আর এক ডিজাইনার দেব তাঁর বসন্তসম্ভারে হাতড়েছেন ফ্লোরাল প্রিন্টকে। “ফুল-ফুল ছাপায় ঢিলেঢালা সুতির লম্বা ম্যাক্সি এ বার ইন থিং। ফ্লোরাল প্রিন্টের শিফনও চাইছেন অনেকে,” বলছিলেন তিনি। রঙের ব্যাপারে দুই ডিজাইনারই একমত। নরম গোলাপি রং-ই বসন্তের পরিচয়।
ওই গোলাপি আবিরেরই তো আর এক নাম ফাগ! আবির আর রঙেই তো দোল। যার আর এক নাম মদনোৎসব! রঙিন উৎসবে, প্রকাশ্যে তাকে ছোঁয়া। ভেতরের লুকোনো অনুভূতি জানে শুধু সে আর আমি। একমাত্র হিন্দি ছবিই জানে সেই গোপন রক্তক্ষরণের যথার্থ অনুভূতি। ‘হোলিকে দিন দিল খিল যাতে হ্যায়।’ তখন ধর্মেন্দ্র পিচকিরি দিয়ে হেমার গায়ে রং ছেটান, অমিতাভ নাচতে গিয়ে দূরে বিধবা জয়াকে দেখে থমকে যান। কিংবা কয়েক গ্লাস সিদ্ধি খেয়ে ‘সিলসিলা’। সঞ্জীবকুমার আউট হয়ে ঢোল বাজান, জয়া ভাদুড়ি নীরব। আর তখনই অমিতাভ পুরনো প্রেমিকা, অধুনা সঞ্জীবকুমারের স্ত্রী রেখাকে টেনে নেন কাছে, ‘ও রঙ্গ বরসে ভিগে চুনারওয়ালি...’
বাংলা সিনেমার দোল অবশ্য এই পরকীয়াতে বিশ্বাস রাখেনি। সে শুধুই ‘সুস্থ রুচির পারিবারিক হোলি’ খেলেছে। ‘দাদার কীর্তি’ ছবিতে তাই আবির ওড়ে। প্রবাসী শমিত ভঞ্জ স্যুটকেস হাতে বাড়ি ফেরেন, আয়নার সামনে সন্ধ্যা রায় সিঁদুরের টিপ পরেন, রাস্তায় গান বাজে, ‘এই এলো রে এলো রে হোলি এলো রে। রঙে রঙে মনপ্রাণ রাঙা হল রে।’ বড় জোর অপর্ণা ভিক্টরকে ‘একান্ত আপন’ করে বলেছেন, ‘খেলব হোলি, রং দেব না তাই কখনও হয়।’
স্বকীয়া-পরকীয়ার মনুষ্যসৃষ্ট, ছেঁদো ভাগাভাগি থাকুক। বসন্তের জয়ধ্বজা আসলে এক জায়গায়। হৃদয়ের গোপন স্বেচ্ছাচারী কামনাকে ছাড়পত্র দেয় সে। কালিদাসের ‘ঋতুসংহার’ কাব্যে বসন্ত বর্ণনার প্রথম শ্লোকের অর্থই: ‘প্রিয়ে! রতি-লালস কামীগণের হৃদয় বিদ্ধ করিবার নিমিত্ত, ওই দেখ, প্রবল যোদ্ধার মতো বসন্তকাল উপস্থিত। সুন্দরী, তোমার ন্যায় বসন্তের সবই সুন্দর। ওই দেখো, গাছে গাছে ফুল, জলে জলে পদ্ম এবং অঙ্গনামাত্রেই আজ কামশরে জর্জরিত।’ সংস্কৃত কবিরা কামকে যে মর্যাদা দিয়েছিলেন, বাঙালি আজও পারল না।
বসন্ত অবশ্য নেতির কথা বলে না, সে আশার ঋতু। শীতের জীর্ণতা, পাতা ঝরার শেষে কচি সবুজ পাতায় প্রাণের ছন্দ নিয়ে আসে সে। শীতের ঝরা পাতাতেই তো লুকিয়ে থাকে তার আগমনবার্তা।
রবীন্দ্রনাথ শীত-বসন্তের এই ভাগটা ধরেছিলেন আরও জটিল ভাবে। বসন্তে নতুন ফুল ফোটে, আবার শুকনো পাতাও ঝরে যায়।
‘বসন্তে কি শুধু কেবল ফোটা ফুলের মেলা রে
দেখিস নে কি শুকনো-পাতা ঝরা-ফুলের খেলা রে।’

ফোটা ফুল ও শুকনো পাতা তাঁর জীবনে একই ডায়ালেকটিকের অঙ্গ।
বসন্ত উধাও, কিন্তু কামনাবাসনা আর জীবনের ডায়ালেকটিক আজও রয়ে গেল!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.