জ্ঞান দিয়ো না
মসনদের বোলিং মার্কে
পাকিস্তানে আর কিছু দিনের মধ্যেই সাধারণ নির্বাচন। ঠিক এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের এক রাজনীতিবিদ মনে করেন তিনি দেশের জন্য গত দু’দশক ধরে যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তাতেই দেশের সাধারণ মানুষ গত ছ’বছরের অবস্থাকে ভুলে যেতে বাধ্য।
সেই রাজনীতিবিদের নাম ইমরান খান। আজকের ইমরান পুরো পাকিস্তান চষে বেড়াচ্ছেন। আজকে পেশোয়ার তো কাল নিজের নির্বাচনী কেন্দ্র মিনানওয়ালি, তার পর দিন হয়তো ইসলামাবাদ।
এত ব্যস্ত তিনি যে প্রথম প্রেম ক্রিকেট নিয়ে ভাবারই অবকাশ নেই এই কিং খানের। এই তো কিছু দিন আগের ঘটনা। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পাকিস্তানের ইনিংস ঊনপঞ্চাশ রানে শেষ। খবরটা পেয়ে দুঃখ পেয়েছিলেন খুব। কিন্তু আজকের ইমরান মনে করেন, ক্রিকেটে পাকিস্তানের এই ভরাডুবি আসলে দেশের অবক্ষয়ের প্রতীক মাত্র। রাজনীতি আর দুর্নীতি এই দু’টোই ভেতর থেকে শেষ করে দিয়েছে দেশটাকে, ক্রিকেট তো তার বাইরে নয়।

বিশ্বকাপ হাতে
আজ থেকে ঠিক একুশ বছর আগে দেশের মানুষকে বিশ্বকাপ উপহার দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ২০১৩তে ইমরান খানের কাছে সাফল্য পারিবারিক ধনসম্পত্তির মতো। কখনও কখনও তার দরকার পড়ে। কিন্তু সব সময় কাজে আসে না।
আজকের ইমরান অনেক পরিণত। তাঁর লক্ষ্য দেশের মানুষের ভোট, যা তাঁকে বসাতে পারে উজির-এ-আলমের কুর্সিতে। “কপালে থাকলে ঠিক হবে,” এই কথাটা প্রায়ই বলতে শুনি তাঁকে। কিন্তু এই পিচটা তো ক্রিকেটের বাইশ গজ থেকে অনেক ভয়ঙ্কর। ক্রিকেট যতটা সদয় ছিল তাঁর উপর, ক্রিকেট যা দিয়েছে ইমরানকে, রাজনীতি কি তা দিতে পারবে?
বলিউডে কিং খান আসার অনেক আগে ক্রিকেট বিশ্বের এই কিং খানের তোলপাড় ফেলে দেওয়া আবির্ভাব হয়েছিল।
সত্তর বা আশির দশকে বেড়ে ওঠা যে কোনও মেয়েকে জিজ্ঞেস করে দেখুন সে কথা। এক বাক্যে এটাকে সত্যি বলে স্বীকার করবে। তবে এই খানকে ভাললাগার সঙ্গে খানিকটা দেশদ্রোহিতার পাপবোধ জড়িয়ে থাকত আমাদের মনে। বিশ্বকাপ হাতে কপিল দেবের হাসিমুখের ছবিটা আমাদের কাছে খুব প্রিয় ছিল ঠিকই, তবে তা আমাদের বুকে ধুকপুকানি জাগানোর কারণ ছিল না। সেটা হত যখন ক্রিজে ইমরান খান ঘোড়ার গতিতে বল নিয়ে ছুটে আসতেন। অশ্বগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উড়ত তাঁর চুল। বীর শিকারির মতো সরু চোখ নিয়ে বল হাতে ধেয়ে আসতেন তিনি।
বলা বাহুল্য ইমরানের শিকার শুধু ভারতীয় ব্যাটসম্যানরাই ছিলেন না। ভারতীয় হিসেবে আমরা অবশ্যই চাইতাম যে মোহিন্দর অমরনাথ যেন আউট না হন। তবে তার সঙ্গে ইমরানকেও কিন্তু ভাল বল করতেই হবে!
পাকিস্তান ক্রিকেট দলে যে সব ক্রিকেটার একই সঙ্গে অসম্ভব প্রতিভাবান এবং অসাধারণ সুদর্শন ছিলেন, ইমরান তাঁদের অন্যতম। ইমরানের পরে আসবে ওয়াসিম আক্রম বা সইদ আফ্রিদিদের নাম। এবং এই জন্যই উনি এত স্পেশাল। শুধুমাত্র সুদর্শন আখ্যা দিয়ে যাঁকে বোঝানো যায় না। ওঁর গণ্ডি তার চেয়ে অনেক বড়।
সত্তর-আশির দশকের মেয়েরা যেমন বেড়ে উঠেছে, তেমনই ইমরানও দিনকে দিন পরিণত হয়েছেন। এই মুহূর্তে ইমরানকে সমর্থন করার মধ্যে কোনও নিষিদ্ধতার গন্ধ নেই। কারণ সাম্প্রতিক পাকিস্তানের রাজনৈতিক অচলাবস্থার উত্তর হয়ে উঠতে পারেন তিনি।
গ্রিক দেবতার মতো দেখতে, গতির এই অধীশ্বর সত্তরের দশকে ছিলেন এক অসাধারণ অধিনায়ক। আশির দশকে তিনিই হয়ে উঠলেন অক্লান্ত সমাজসেবক। নব্বইয়ে এসে তিনি এই সহস্রাব্দের এক আদর্শবাদী রাজনীতিবিদ। এর থেকে ভাল অলরাউন্ডার আর কে হতে পারেন! সামনেই হয়তো পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে দেওয়ার মতো একটা নির্বাচন আসবে। ইমরানের প্রতি যুবসমাজের সমর্থন বাঁধ ভাঙা জলের মতো। অন্য দিকে বয়স্ক রাজনীতিবিদদের ভোটব্যাঙ্কও সুরক্ষিত। আসলে ইমরান রাজনীতিবিদ থেকে নেতা হওয়ার পরিপন্থী।
তিনি তো জন্ম থেকেই নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। তাঁর ম্যানিফেস্টো বালখিল্য মনে হতে পারে। এই যেমন তিনি বলেছেন দূর্নীতি দূর করবেন, সন্ত্রাসবাদ মুছে দেবেন আর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নত করবেন, ভোটে জিতে আসার একশো দিনের মধ্যে। কথাগুলো সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার অংশগ্রহণকারীর মুখে ভাল শোনালেও ইমরান কিন্তু সত্যিই সেটা চান। রাজনীতিতে তাঁর সতেরো বছর হয়ে গেল। তবু তাঁর সাহস, আত্মবিশ্বাস আর তীব্র প্রচেষ্টা দেখে মনে হয় তিনি যেন এই সময়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। কে বলতে পারে হয়তো এ বারের নির্বাচনে জিতেই এগিয়ে যাবেন তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে।

জেমাইমার সঙ্গে ইমরান
যখনই কোনও লক্ষ্যে সফল হয়েছেন, সেটা ছেড়ে ইমরান বেরিয়ে পড়েছেন অন্য কোনও লক্ষ্যকে স্পর্শ করতে। ১৯৯২-এর পর ইমরান চাইলে বিশ্বের সেরা ধারাভাষ্যকার হয়ে জেমাইমা গোল্ডস্মিথের সঙ্গে চুটিয়ে জীবন কাটাতে পারতেন। তার বদলে তিনি দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার হাল দেখে দুঃস্থদের জন্য বিশ্বমানের একটি দাতব্য ক্যানসার হাসপাতাল তৈরির কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
এই ক্যানসার হাসপাতাল নির্মাণের জন্য তিনি পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত মানুষজন আর ইংল্যান্ডে তাঁর বন্ধুদের সাহায্য নেন। শওকত খানুম হাসপাতালের পরিসর গত দু’দশকে বাড়লেও তার গুণগত মানে কোনও খামতি পড়েনি। এই হাসপাতাল তাঁর মায়ের নামে তৈরি। যে মহিলাকে ইমরান কোনও দিনই ভুলতে পারেননি। জীবনের কঠিন দিনগুলোর কথা মনে পড়লেই মায়ের স্মৃতি ভেসে উঠেছে। ইমরানকে দেখে যতই কঠিন হৃদয় মনে হোক না কেন, বিচ্ছেদের সুর তাঁর মনেও বাজে। কথা উঠলেই চলে যান মায়ের মৃত্যু কিংবা স্ত্রী জেমাইমা আর ছেলেদের সঙ্গে বিচ্ছেদের প্রসঙ্গে। তাঁর ছেলে সুলেমান আর ওয়াসিম পাকিস্তানে এলেই জীবনের আর সব কিছুকে ভুলে যান তিনি। জেমাইমা প্রাক্তন স্ত্রী হলেও তাঁর সঙ্গে ইমরানের মধুর সম্পর্কই আছে। তিনি লন্ডনে গেলে জেমাইমার পারিবারিক বাড়িতেই থাকেন।
ইমরান তাঁর স্বভাবসিদ্ধ উষ্ণতা, প্যাশন, আর নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে যে দিন সংসদে ঢুকবেন সে দিন একটা ঝড় তো উঠবেই। পাকিস্তানে তাঁর জাতীয় দল তৈরির চেষ্টা বারবারই ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু তাঁর মতে যুবসমাজের সমর্থন সব সময় তাঁর সঙ্গে ছিল, আছে, থাকবে। কিন্তু সবাই তা মনে করেন না। তাঁরা বলেন ইমরানের সমর্থকরা তাঁর পার্টির যোগ্যতা সম্বন্ধে সন্দিহান।
ইমরানকে দেবজ্ঞানে পুজো করা ক্রিকেটারেরা বলেন, দলের বিক্ষোভ মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়া আর সরকার পরিচালনা দুটো ভিন্ন ব্যাপার। তিনি অন্য দলের নেতাদেরও নিজস্ব রাজনীতিতে জড়াতে চেভারতীয় টেলিভিশনের একটি টক শো-তে ইমরান তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক নীতি নিয়ে বেশ কিছু যুক্তিগ্রাহ্য কথা বলেছেন। তিনি বলেন প্রথম একশো দিনই হল ‘হনিমুন পিরিয়ড’। ওই সময়ই কোনও সরকারকে যা পরিবর্তন করার করে ফেলতে হবে। তার পরেই রাজনৈতিক বিভিন্ন বাধা এসে সৎ উদ্দেশ্যকে প্রতি পদে বিঘ্নিত করবে। তাঁকে প্রশ্ন করা হয় কেন তিনি তালিবান বা কট্টর ইসলামপন্থীদের সঙ্গে কথাবার্তা চালানোর ব্যাপারে এত আগ্রহী, যখন তিনি নিজে ধর্মীয় দিক থেকে অনেক বেশি মুক্ত চিন্তাধারায় বিশ্বাসী! তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, সব ধরনের মতাবলম্বীর সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে হবে। অন্য মতকে সংখ্যালঘু করার বা একঘরে করে দেওয়ার চেষ্টা তাঁদের প্রত্যাঘাতের রাস্তাতে ঠেলে দেওয়ারই শামিল। শেষে তিনি জেনারেল মুশারফের মেরুদণ্ডহীনতার কঠোর সমালোচনা করেন। কারণ মুশারফের জন্যই আজ পাকিস্তান এমন এক যুদ্ধে জড়িত যেটা হওয়ারই কথা নয়। এমনকী আসিফ জারদারিকে তুলোধোনা করতেও ছাড়েননি তিনি। বলেন, ‘‘জারদারি দেশের সব চেয়ে বড় জালিয়াত।’’
ক্ষমতার হাতছানিকে স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছেন ইমরান। মুশারফ সরকারের বড় পদও ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি। কারণ তিনি কারও হাতের পুতুল নন, নেতৃত্ব দিতে চান। তাঁর প্রখর আদর্শবাদী চিন্তাভাবনা কখনও কখনও বাস্তববাদীদের চোখে বালখিল্য মনে হতে পারে।
এই উপমহাদেশের রাজনীতিবিদরা খুব ছিদ্রান্বেষী আর তাঁদের এই স্বভাব ভোটদাতাদের মোটেই বিশেষ ভাবায় না। তাই এই বছরের শেষে পাকিস্তানের ভোটে কী হয় সেটা লক্ষ রাখার মতো। ইমরানের ক্যারিশমা আছে, তরুণ সমাজের সমর্থন আছে, নিজের চিন্তার দৃঢ়তা আছে। সেই সঙ্গে আছে দেশকে নেতৃত্বদানের ক্ষমতা। কিন্তু তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদেরও তো অনেক দিন হয়ে গেল এই ব্যবস্থার সঙ্গে ঘর করা। তাঁরা কি এত সহজে ইমরানকে জিততে দেবেন? তবে কে জানে হয়তো সেই পুরোনো মুখগুলোকেই আবার দেখা যাবে।


এক নির্বাচনী জনসভায় ইমরান

বাঁধভাঙা সমর্থনের সুনামি হয়তো আঠারো মাস আগেই এসে গিয়েছে। ২০১১-র নভেম্বর কী ২০১২-র ফেব্রুয়ারিতেই তো সেটা দেখা গিয়েছিল। তার পরেই তাতে ভাটা আসে। এখন এটাই দেখার আগামী ভোটে সেই সমর্থনের প্রতিফলন দেখা যায় কি না।
আর যদি ইমরানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফের জন্যই ২০১৩ সাল খুশির দিন বয়ে আনে? তখনও ইমরান বড় স্বপ্নের পিছনে ধাওয়া করা থামাবেন না। এই ষাটেও তাঁকে চল্লিশোর্ধ্ব শ্রান্ত রাজনীতিকদের থেকে অনেক যুবক মনে হয়। আর তাঁর স্বপ্ন দেখার তো কোনও বিরামই নেই। আপাতত ইমরান সুযোগের অপেক্ষায়।
একবার জেমাইমা তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন কত বছর ধরে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার স্বপ্ন দেখবেন? যেখানে বলার মতো কোনও সাফল্যই তিনি পাচ্ছেন না। ইমরানের উত্তর ছিল ‘‘স্বপ্ন দেখার কোনও সময়সীমা নেই।’’



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.