এ বারের বাজেটে বরাদ্দ কমানো নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক বা প্রশ্ন উঠলেও জমি জটে বৃহত্তর কলকাতার মেট্রো প্রকল্পগুলির যা হাল, তাতে আদৌ সেগুলির কাজ কবে শেষ হবে, সে হদিস দিতে পারছেন না কেউই।
এ ভাবে অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা প্রকল্পগুলির মধ্যে রয়েছে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো, জোকা-বিবাদী বাগ, নোয়াপাড়া-দক্ষিণেশ্বর, বরাহনগর-ব্যারাকপুর, দমদম-বারাসত পর্যন্ত সম্প্রসারণ।
২০০৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পরে প্রথম পর্যায়ের কাজ এত দিনে শেষের মুখে পৌঁছনোর কথা ছিল। কিন্তু ১৪৭.৬৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রকল্পের কাজের এক-তৃতীয়াংশও হয়নি। প্রস্তাবিত প্রকল্পব্যয় ছিল ৪৮৭৪ কোটি ৫৮ লক্ষ টাকা। ক্রমে তা বেড়েই চলেছে। মহাকরণের কাছে সেন্ট্রাল স্টেশনে এই মেট্রোর সঙ্গে কবি সুভাষ-দমদম রুটের মেট্রোর সংযোগ স্থাপনের কথা। এর জন্য সেখানে ১.৫৯৯ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। জমির প্রয়োজনে তুলতে হবে বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের বাসিন্দা ও দোকানিদেরও। এই দুই জটিলতা এড়াতে রাজ্য সরকার ‘রাইটস’-কে দিয়ে এই প্রকল্পের পরিবর্ত মানচিত্র তৈরি করিয়েছিল। এই প্রকল্পের পুরো দায়িত্বই এখন রেলের। ফলে, রাজ্যের পরামর্শ তারা মানতে রাজি নয়। |
কী ভাবে সমাধান মিলবে? রাজ্যের পুরসচিব তথা কেএমআরসি-র প্রাক্তন এমডি ভগবতীপ্রসাদ গোপালিকার বক্তব্য, “আমাদের প্রস্তাবটা অনেক বাস্তবসম্মত ছিল। এটা মেনে নিলে ঝামেলা কম হত। কাজ শেষ হত দ্রুত।” অন্য দিকে রেলের বক্তব্য, “নয়া নকশায় দৈর্ঘ্য বেড়ে যাচ্ছে দেড় কিলোমিটার। ফলে বাড়তি খরচ হবে ১৫৭ কোটি টাকা। জমি-জট দেখা দেবে অন্য রূপে।” কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “আমরা চাই প্রকল্পটা হোক। কিন্তু এতে আমাদের সিদ্ধান্তের কোনও অবকাশ এখনও পর্যন্ত নেই।”
জমির সমস্যা রয়েছে নোয়াপাড়া-দক্ষিণেশ্বর-ব্যারাকপুর প্রকল্পেও। নোয়াপাড়া থেকে বরাহনগরের মধ্যে সাড়ে চার কিলোমিটার এলাকায় প্রায় ৫০০টি পরিবার রয়েছে। রেলের অভিযোগ, তাঁদের সরানোর ব্যাপারে রাজ্য সরকার উদ্যোগী হয়নি। অন্য দিকে, ব্যারাকপুর পর্যন্ত বিটি রোডের নীচে পলতা-টালার জলের পাইপ কী ভাবে সরানো হবে, তা নিয়েও সমস্যা রয়েছে। মেট্রো কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, পুরসভা এই পাইপ না-সরালে জমি মিলছে না। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “বিটি রোডের নীচ দিয়ে কলকাতার জল সরবরাহের সবচেয়ে বড় পাইপ গিয়েছে। আমরা পরিবর্ত পাইপ বসালেও পুরনো পাইপ এখনই বন্ধ করা যাচ্ছে না। কবে পুরনো পাইপ সরানো যাবে, তার আন্দাজও দিতে পারব না।” এ কারণে মেট্রো কর্তৃপক্ষের কাছে পুরসভা আরও কিছু তথ্য চেয়েছে বলে শোভনবাবু জানান। |
জোকা-বিবাদী বাগ প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষে। মেট্রো রেল সূত্রের খবর, গত আর্থিক বছরে কাজ কার্যত শুরু করাই যায়নি। কারণ, ট্রাম লাইন সরানো নিয়ে বাম সরকারের সঙ্গে তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের টানাপোড়েন চলছিল। তৃণমূলের আমলে ওই কাজ শুরু হলেও প্রথম সমস্যা দেখা দেয়, মাটির উপরে স্টেশন তৈরির জমি পাওয়া নিয়ে। রেল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, প্রতিটি জায়গাতেই দখলদার রয়েছেন। দখলদার সরানোর ব্যাপারে রাজ্য সরকারকে বার বার জানিয়েও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তারাতলায় টাঁকশালের সামনে ও সেনাবাহিনীর অধীনে থাকা ময়দান এলাকায় কী ভাবে মেট্রোর জমি মিলবে, সে সমস্যার সমাধানও হয়নি।
মেট্রো কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, ওই দু’টি জায়গায় মেট্রো মাটির তলা দিয়ে যাবে, না উপর দিয়ে তা-ই এখনও ঠিক করা যায়নি। ফলে নকশাও চূড়ান্ত করা যায়নি। কিছুটা কাজ করেও চলতে হচ্ছে ঢিমেতালে। প্রকল্পের ১০ শতাংশ কাজও হয়নি। মহাকরণে পরিবহণ দফতরের এক পদস্থ অফিসার স্বীকার করেন, দখলদারদের জন্য প্রকল্পের জমি পেতে অসুবিধা হচ্ছে। এ ব্যাপারে তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী নিজে যেখানে দখলদারদের হয়ে প্রকাশ্যে সরব, সেখানে আমরা কী করতে পারি?” |
জমি জটে আটকে গিয়েছে দমদম-বারাসত মেট্রো সম্প্রসারণ প্রকল্পও। রেল সূত্রের খবর, মধ্যমগ্রাম থেকে বারাসত পর্যন্ত রেলের জমির উপর দিয়েই মেট্রোর লাইন নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই জমি জবরদখল হয়ে গিয়েছে। পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ ওই জমি প্রায় ১৬০০টি পরিবার দখল করে রেখেছেন। ওই জবরদখল উচ্ছেদ করার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। রেলের পক্ষ থেকে রাজ্য সরকারকে সাতটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। একাধিক বৈঠকও হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি বলে অভিযোগ। রেলের দাবি, রাজ্য সরকার জানিয়ে দিয়েছে, দখলদার তোলা যাবে না। |