ডিজেলের দাম বাড়ার ফলে আর এক দফা দাম বাড়তে পারে ডিজেলের!
হেঁয়ালি নয়। সিধেসাপটা অর্থনীতির যুক্তি। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে রেলমন্ত্রী পবন বনশল আজ সব রকম পণ্য মাসুল বাড়িয়েছেন। রেলে ডিজেল পরিবহণের মাসুলও রয়েছে তার মধ্যে। এর ফলেই ডিজেলের দাম নতুন করে বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তা সে যত অল্প পরিমাণেই হোক।
শুধু ডিজেল নয়। রেল পণ্য মাসুল বাড়ানোয় প্রায় সমস্ত খাদ্যপণ্য এবং জ্বালানির দাম কিছুটা হলেও বাড়তে চলেছে বলে অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন। যার ধাক্কায় সামগ্রিক ভাবে আরও একপ্রস্ত মূল্যবৃদ্ধির প্রবল আশঙ্কা। অর্থাৎ ঘুরপথে সেই আমজনতার পকেটেই কোপ পড়তে চলেছে বলে অভিযোগ তুলেছেন বিরোধীরা। অর্থনীতিবিদরাও এই অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছেন না। লোহা থেকে কয়লা সিমেন্ট, সব কিছুরই পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় তা ভারী শিল্প ও নির্মাণশিল্পে যেমন ছাপ ফেলবে, তেমনই বাড়তে পারে বিদ্যুতের দামও।
জানুয়ারি মাসে পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে। কিন্তু খুচরো মূল্যবৃদ্ধির হার এখনও ১০ শতাংশের উপরে। এর মধ্যেই আজ রেলে সব রকম পণ্য পরিবহণের খরচ ৫.৮ শতাংশ হারে বাড়ল। এর মধ্যে তা-ও ভিড়ের সময় যে বাড়তি মাসুল চাপানো হয় এবং উন্নয়ন বাবদ যে মাসুল আদায় করা হয়, তা ধরা হয়নি। কেউ বলছেন, ১৭ বছর পর কংগ্রেসের কোনও রেলমন্ত্রী যে বাজেট পেশ করলেন তাতে অন্তত ০.২৫ শতাংশ হারে বাড়তি মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে। কারও মতে তা ০.৭ থেকে ০.৮ শতাংশেও পৌঁছতে পারে।
বাম-বিজেপি একসঙ্গে অভিযোগ তুলেছে, চাল-গম সহ সমস্ত খাদ্যশস্য, ডাল, বাদাম তেল এবং ইউরিয়া জাতীয় পণ্যের পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় এ সবের দাম সরাসরি বাড়বে। রেলমন্ত্রীর অবশ্য দাবি, প্রতি কেজি খাদ্যশস্যে খুব বেশি হলে ৪ থেকে ৮ পয়সা দাম বাড়বে। কিন্তু বিরোধীরা তা মানতে রাজি নন। খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি কয়লা, ডিজেল, রান্নার গ্যাস, কেরোসিন পরিবহণের খরচ বেড়ে যাওয়ায় গৃহস্থের হেঁশেলেও জ্বালানির দাম আরও দফা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকছে।
ডিজেলের দাম বাড়লে সড়ক পরিবহণের খরচও বাড়বে। কয়লার দাম বাড়লে বাড়বে বিদ্যুতের দাম। অর্থনীতিবিদ অনুভূতি সহায়ের বক্তব্য, “বাড়তি মাসুলের বোঝা কতখানি আমজনতার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হবে, তার উপরেই নির্ভর করছে মূল্যবৃদ্ধির হার কতটা বাড়বে।” তেল সংস্থাগুলি এখন রেলের মাধ্যমে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ডিজেল, রান্নার গ্যাস এবং কেরোসিন পরিবহণ করে। এখন বাড়তি পরিবহণের খরচ তেল সংস্থাগুলিকে হয় আমজনতার ঘাড়ে চাপাতে হবে, নয়তো সরকারকেই ভর্তুকি বাড়তি বোঝা বহন করতে হবে। একই ভাবে ইউরিয়ার দাম না বাড়ালে ভর্তুকি বাড়বে সারে। সরকারি সূত্রের বক্তব্য, এমনিতেই মনমোহন সরকারের যা রাজকোষের অবস্থা, তাতে অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম এই বাড়তি বোঝা বইতে রাজি হবেন, তার সম্ভাবনা খুবই কম। কাজেই শেষ পর্যন্ত বোঝা চাপবে আমজনতার ঘাড়েই।
চাপে পড়বে ভারী শিল্পও। লোহা-ইস্পাত, আকরিক লোহা, কাঁচা লোহা, সিমেন্ট পরিবহণের মাসুল বৃদ্ধি ভারি শিল্পের উৎপাদন খরচও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন রফতানিকারী সংস্থাগুলির সংগঠনের সভাপতি রফিক আহমেদ। ক্রিসিল-এর মুখ্য অর্থনীতিবিদ ডি কে জোশী অবশ্য মনে করছেন, রেলে মাসুলবৃদ্ধির ফলে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে ঠিকই। কিন্তু মন্দার জেরে বাজারে চাহিদাও নিম্নমুখী। তাই বাড়তি পণ্য মাসুলের কারণে বড়সড় ধাক্কা আসার সম্ভাবনা কম। প্রাইসওয়াটারহাউস-কুপার্সের মণীশ অগ্রবালের আবার যুক্তি, যে-হেতু অধিকাংশ পণ্যই সড়কপথে পরিবহণ হয়, তাই রেলের মাসুল বৃদ্ধির ধাক্কা বড়সড় প্রভাব ফেলবে না।
সিপিএম-নেতা সীতারাম ইয়েচুরির অভিযোগ, “সরকার বেসরকারি পণ্য পরিবহণকে ডিজেলে ভর্তুকি দিচ্ছে। কিন্তু রেল ও রাজ্যের সরকারি পরিবহণ সংস্থাগুলিকে বাজার দরের থেকে প্রতি লিটারে বাড়তি ১১ টাকা দিতে হচ্ছে। তার ধাক্কা গিয়ে লাগছে সব ক্ষেত্রে।”
বিরোধীদের পাশাপাশি আজ নরেন্দ্র মোদী, জয়ললিতা-র মতো মুখ্যমন্ত্রীরাও ইউপিএ-সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে ঘুরপথে বোঝা বাড়ানোর অভিযোগ তুলেছেন। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা মানছেন, মাসুল বাড়ানো ছাড়া সরকারের সামনে কোনও উপায়ও ছিল না। কারণ, রেল তথা মনমোহন সরকারের রাজকোষের যা অবস্থা, তাতে অবিলম্বে ঘাটতিতে লাগাম পড়ানো জরুরি। রাজকোষ ঘাটতির জেরেই মূল্যবৃদ্ধির চাপ বাড়ছে সব থেকে বেশি। ফলে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হলেও সেটা নিতে হচ্ছে আর্থিক বৃদ্ধির কথা ভেবেই। তাই মাসুল বৃদ্ধিতে জিনিসপত্রের দাম সামান্য বাড়লেও দীর্ঘমেয়াদি লাভের কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন ছিল। পবন বনশল যে ভাবে আর্থিক শৃঙ্খলায় জোর দিয়েছেন, তাকে স্বাগত জানিয়েছে ফিকি ও সিআইআই-এর মতো বণিকসভাগুলি। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, আজকের রেল বাজেট থেকে আর একটি ইঙ্গিতও মিলছে। তা হল, বৃহস্পতিবার সাধারণ বাজেট পেশ করতে গিয়েও অর্থমন্ত্রী চিদম্বরম রাজকোষ ঘাটতিতে শক্ত হাতে রাশ টানবেন। সাধারণ নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে বাজেটে কিছু জনমোহিনী পদক্ষেপ থাকলেও সব রকম খরচেই বিপুল পরিমাণে কাটছাঁট করা হবে। |