ভাড়া বাড়ল কি? কতটা?
রেল বাজেট ঘিরে এত দিন ধরে আমজনতার আগ্রহটা এই দু’টি প্রশ্নেই আবর্তিত হয়েছে। এ বারের বাজেট থেকে দীর্ঘদিনের এই রীতিকে কার্যত অপ্রাসঙ্গিক করার কাজ শুরু করে দিলেন রেলমন্ত্রী পবন বনশল।
বহু দিন ধরেই রেল এবং সাধারণ বাজেট তার চরিত্র হারাতে শুরু করেছিল। আগে যেমন বাজেট নিয়ে গোপনীয়তা বজায় রাখা হত, এখন তা আর সে ভাবে মানা হয় না। সংসদে বাজেট ঘোষণার আগেই সংবাদমাধ্যমে বহু খবর ফাঁস হয়ে যায়। বাজেট পেশের আগেই সরকারের না দফতর এমনকী কিছু মন্ত্রীও প্রকাশ্যেই বলে দেন, কী কী উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ করা হতে চলেছে বাজেটে! এর ফলে বেশ কিছু দিন ধরেই বাজেট তার আকর্ষণ হারিয়ে নিছক আয়ব্যয়ের নীরস খতিয়ানে পরিণত হয়েছে। আর পবন বনশল তার থেকেও এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। বাজেটের এক মাস আগেই রেলের ভাড়া বাড়িয়েছেন। আজ জানালেন, যে হেতু সদ্য ভাড়া বাড়ানো হয়েছে, তাই এখন আর যাত্রীভাড়া বাড়িয়ে বাড়তি বোঝা চাপাতে চান না। তবে এখন না বাড়ালেও বাজেটের বাইরে ভাড়া বাড়ানোর পথ খুলে দিলেন তিনি। যাতে ভবিষ্যতে যাত্রীভাড়া বৃদ্ধির আর কোনও দায় সরাসরি সরকারের ঘাড়ে না চাপে। যার পোষাকি নাম ‘রেল ট্যারিফ অথরিটি’। রেলের ভাড়া নিয়ন্ত্রক কমিটি।
জোট নেতারা যখন রেল মন্ত্রকের দায়িত্বে ছিলেন, তখন থেকেই মনমোহন সিংহ-মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়ারা এ ধরনের ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। কিন্তু মনমোহন-মন্টেকের সেই সংস্কারের পথ নিতে রাজি হননি প্রাক্তন অনেক রেলমন্ত্রীই। এই অবস্থায় বনশল আজ জানান, তাঁর পূর্বসূরি দীনেশ ত্রিবেদী একটি স্বাধীন সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেই প্রস্তাবটি এখন মনমোহন-সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রকে আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। রেল মন্ত্রক সূত্রের মতে, খুব শীঘ্রই প্রস্তাবটি মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন নিয়েও ভাবনাচিন্তা চলছে। মন্ত্রকের মতে, ভারতীয় রেলে যাত্রী ভাড়া সব থেকে কম এবং পণ্য মাসুল সব থেকে বেশি। ফলে এর মধ্যে একটি সামঞ্জস্য আনা প্রয়োজন। রেল বোর্ডের প্রাক্তন সদস্য শান্তি নারায়ণের কথায়, “রেল ভাড়ার বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। রেলের আর্থিক অবস্থা যখন ধীরে ধীরে বেহাল
হয়ে যাচ্ছে, তখনও যাত্রীভাড়ায় হাত দেওয়া হয়নি।” মন্ত্রকের মতে, অন্য সব কিছুর মতোও রেলের ভাড়ার বিষয়টিও বাজারের হাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত।
তৃণমূল সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদী রেলমন্ত্রী থাকাকালীন এই সংস্থা গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন। আজ তাঁকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি এড়িয়ে যান। বলেন, “এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। মন্ত্রিসভার অনুমোদন দরকার। সংসদেও আনতে হবে। তার পর তো হবে।” ‘রেল ট্যারিফ অথরিটি’র বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট কিছু না বললেও রেলমন্ত্রী আজ জানান, এ বছরের ১ এপ্রিল থেকেই চালু হয়ে যাবে পণ্য মাসুলে জ্বালানি সারচার্জ বদলের বিষয়টি। পেট্রোলিয়াম মন্ত্রক ইতিমধ্যেই বছরে লিটার প্রতি দশ টাকা ডিজেলের দাম বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। ফলে অবধারিত ভাবেই পণ্য মাসুলও বাড়বে। যার প্রভাব পড়বে মুদ্রাস্ফীতিতেও। রেল বোর্ড চেয়ারম্যান বিনয় মিত্তল জানান, “এই ব্যবস্থা কার্যকর হলে ডিজেলের দাম বাড়লে পণ্য মাসুলও বাড়বে বইকি।” রেল মন্ত্রক অবশ্য এ-ও বলছে, এই সংস্থার সুপারিশ মানতে বাধ্য নয় সরকার। গত বাজেটে ‘রেল ট্যারিফ অথরিটি’র ঘোষণা হলেও এখনও পর্যন্ত সরকার তা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। আজ সুযোগ থাকলেও নির্বাচনী বছরে ভাড়া বাড়ানোর সাহস দেখাতে পারেননি রেলমন্ত্রী। ফলে এমনটা মনে করার কোনও কারণ নেই, এই সংস্থা সুপারিশ করলেই তা অবিলম্বে কার্যকর হবে। রেলমন্ত্রী জানেন, যে ভাবেই ভাড়া বাড়ুক, তার জন্য রাজনৈতিক বিরোধিতার মুখে পড়তেই হবে। আজই বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংহ বলেছেন, “সরকার ঘুরপথে ভাড়া তো বাড়াচ্ছেই। তার উপর পবন বনশল একটি নতুন মডেল উদ্ভাবন করছেন, বাজেটের বাইরে যাতে ভাড়া বাড়িয়ে মানুষের উপর আরও বোঝা বাড়ানো যায়!” তৃণমূলের সৌগত রায়ও বলেন, “আমরা এর বিরোধিতা করছি, কারণ সরকার সংসদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। ভাড়া বাড়ানোর অধিকার একমাত্র সংসদের আছে।” তাঁর অভিযোগ, সরকার সংসদকে এড়িয়ে জনগণের ঘাড়ে বোঝা চাপাতে চাইছে। |