বহু টাকা ফেরত, তাই কোপ
বিপুল বরাদ্দ ছাঁটাই মমতার প্রকল্প
শঙ্কাটা বেশ কিছু দিন ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছিল। বাজেটে আজ তা সত্যি প্রমাণ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষিত বাংলার রেল প্রকল্পগুলিতে বরাদ্দ এক ধাক্কায় অনেকটাই কমিয়ে দিলেন পবন বনশল। মহানগরীর সবক’টি মেট্রো রেল প্রকল্প থেকে রেল কারখানা বা নতুন রেল লাইন পাতার কর্মসূচি গত চারটি রেল বাজেটের তুলনায় বিপুল বরাদ্দ ছাঁটাই হল এ রাজ্যের প্রায় সব প্রকল্পে। রেল প্রতিমন্ত্রী হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের জন্য কিছু নতুন ট্রেন ও নতুন প্রকল্প অবশ্য আদায় করতে পেরেছেন অধীর চৌধুরী। কিন্তু তার পরেও কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বঞ্চনার অভিযোগ তোলার জন্য যথেষ্ট সুযোগ রয়ে গেল বলেই মনে করছেন তৃণমূল নেতৃত্ব।
এ দিন রেল বাজেট ঘোষণার পরপরই রে রে করে ওঠেন তৃণমূল নেতারা। সংসদের ভিতরে-বাইরে সরব নেতৃত্বের অভিযোগ, “এ হল ‘কিল বেঙ্গল’ বাজেট!” তাঁদের এ-ও অভিযোগ, এই বাজেটে কংগ্রেসের ‘বিদ্বেষমূলক মনোভাব’ এবং ‘প্রতিশোধস্পৃহা’ ফুটে উঠেছে। তৃণমূল শিবিরের তরফে যে এমন অভিযোগ উঠবে, সেটা যেন জানাই ছিল রেল প্রতিমন্ত্রী তথা রাজ্য কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীর। তাঁর জবাব, “নিজের সীমাবদ্ধ ক্ষমতার মধ্যেও পশ্চিমবঙ্গের জন্য যতটা সম্ভব করেছি।” মমতা-শিবিরের প্রতি তাঁর পাল্টা অভিযোগ, রেল প্রকল্প নিজেদের রাজ্যে না আনতে পারার পিছনে তৃণমূল সরকারেরও যথেষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। মমতার ‘অকর্মণ্যতা’ নিয়ে শীঘ্রই সংসদে শ্বেতপত্র প্রকাশের কথাও আজ ঘোষণা করেছেন অধীর। ছেড়ে কথা বলেননি রেলমন্ত্রী পবন বনশলও। পশ্চিমবঙ্গকে বঞ্চনা করা হয়েছে, এই অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে তাঁর সহাস্য কটাক্ষ, “আমি স্বীকার করছি, রেল বাজেটের ৯৮ শতাংশই পশ্চিমবঙ্গে যায়নি!”
আমি স্বীকার করছি, রেল বাজেটের ৯৮ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গে যায়নি!
পবন বনশল,
এ দিনের রেল বাজেটে পশ্চিমবঙ্গের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে ৬টি নতুন এক্সপ্রেস ট্রেন, দু’টি নতুন প্যাসেঞ্জার ট্রেন। সাতটি ট্রেনের গতিপথ বাড়ানো হয়েছে ও দু’টি ট্রেনের যাত্রাসংখ্যা বাড়িয়েছে রেল। তা ছাড়া হাওড়া এবং শিয়ালদহের নিত্যযাত্রীদের কথা ভেবে লোকাল ট্রেনের ক্ষেত্রে ১৮টি নতুন পরিষেবা এবং বারো কামরার ৮০টি নতুন লোকাল ট্রেনের ঘোষণাও হয়েছে। অতীতে চারটি রেল বাজেটে মমতা বা তাঁর পরবর্তী তৃণমূলের রেলমন্ত্রীরা একাধিক রেল কারখানা ঘোষণা করলেও এ বার অধীর চৌধুরীর জেলা মুর্শিদাবাদের জন্য একটি প্যান্টোগ্রাফ কারখানার ঘোষণা ছাড়া কিছুই হয়নি। তবে এই সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে রাজ্যের চলতি সব রেল প্রকল্পে বিপুল বরাদ্দ কমার বিষয়টি।
লোকসভায় বনশলের বাজেট বক্তৃতা চলাকালীনই বঞ্চনার অভিযোগ তুলে সরব হন তৃণমূল সাংসদরা। স্লোগান দিতে দিতে ওয়েলে নেমে আসেন শুভেন্দু অধিকারী, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কাকলি ঘোষদস্তিদাররা। পরে শুভেন্দুবাবু বলেন, “আমাদের নেত্রী যে সব প্রকল্প ঘোষণা করেছিলেন, সেগুলিতে অর্থ বরাদ্দ না করে কার্যত বাতিল করে দেওয়া হয়েছে! এই বাজেট রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে পক্ষপাত করা হয়েছে।” পরে প্রাক্তন দুই রেলমন্ত্রী মুকুল রায় ও দীনেশ ত্রিবেদীকে পাশে নিয়ে তৃণমূল দফতরে সাংবাদিক বৈঠক করে সৌগত রায় বলেন, “এটি কিল বেঙ্গল বাজেট এবং জনবিরোধী, গরিব-বিরোধী বাজেটও বটে।” তৃণমূল নেতৃত্বের অভিযোগ, দিশাহীন এই বাজেটের যদি কোনও দিশা থেকে থাকে, তা হলে তা একটাই। তা হল, তৃণমূল রেল মন্ত্রকে থাকার সময় যে সব প্রকল্প ঘোষণা হয়েছিল এবং যেগুলির কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল, সেগুলিকে খুন করা। দলের এক সাংসদের কথায়, “এমনিতেই কেন্দ্র আমাদের রাজ্যকে আর্থিক ভাবে বঞ্চিত করে রেখেছে। রেল বাজেটের মাধ্যমেও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বিমাতৃসুলভ আচরণ করা হল।” আগামী বছর লোকসভা নির্বাচনের দিকে ইঙ্গিত করে সৌগতবাবু বলেন, “কংগ্রেস যে আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না, তা নিশ্চিত। পরবর্তী নির্বাচনে আঞ্চলিক দলগুলির ভূমিকা অনেকটাই বাড়বে।” তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, আত্মসম্মান থাকলে রাজ্যের বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন রাজ্যের তিন কংগ্রেস মন্ত্রী। সৌগতবাবুর কথায়, “এই বঞ্চনার মধ্যেও মুশির্দাবাদে ‘ললিপপ’ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিমন্ত্রীকে খুশি করার চেষ্টার করা হয়েছে!” যা শুনে বনশলের জবাব, “তৃণমূলের উচিত রাজ্যটাকে সার্বিক ভাবে দেখা।”
রাজনীতির কারবারিদের মতে, তৃণমূলের এই রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। রেলের যা আর্থিক স্বাস্থ্য, তাতে সারা দেশ জুড়েই রেল প্রকল্পে বরাদ্দ কমেছে। মমতা নিজেও যদি এখন রেলমন্ত্রী থাকতেন, তা হলেও পশ্চিমবঙ্গের জন্য বরাদ্দ আদায় করতে তাঁকে হিমশিম খেতে হত। তিনি যে ভাবে চোখ-কান বুজে পশ্চিমবঙ্গের জন্য প্রকল্প ঘোষণা করেছিলেন, তা কংগ্রেসের পক্ষে কোনও একটি রাজ্যের জন্য করা সম্ভব নয়। একই কথা বলেছেন অধীর চৌধুরীও। তাঁর কথায়, “এর আগে রেল বাজেটের নামে বাংলার বাজেট হয়েছে। কিন্তু আমরা তো সেটা করতে পারি না। আমাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে গোটা ভারতের জন্য।” তবে রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, এটা অনস্বীকার্য যে রাজনৈতিক ভাবে তৃণমূল আগেও রেল বাজেটকে অস্ত্র করতে পেরেছিল, এখনও পারবে। আগে রেল বাজেটে ঘোষণার মাধ্যমে তৃণমূল ভোটবাক্সে ঢালাও সুবিধা পেয়েছিল, এ বারে বঞ্চনার অভিযোগ তুলেও সেই চেষ্টাই করবে তারা। আর তাতেই রাজ্য কংগ্রেস বেশ চাপে পড়তে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
রেল মন্ত্রক সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে, তৃণমূল যা-ই বলুক, বাস্তবটা হল, তারা বাজেটে বহু কোটি টাকা বরাদ্দ করলেও তার সিংহভাগই খরচ করা যায়নি বলে ফেরত গিয়েছে। এবং তার অন্যতম কারণ, সাম্প্রতিক একাধিক প্রকল্পে জমি নিয়ে তৃণমূল শাসিত রাজ্য সরকারের টালবাহানা। উদাহরণ হিসেবে উঠছে নোয়াপাড়া-বারাসত ভায়া বিমানবন্দর রেল প্রকল্পের কথা। গত বাজেটেও এই প্রকল্পে ১০৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। কিন্তু এখনও পর্যন্ত খরচ হয়েছে মাত্র ৬০ কোটি! ফলে অকারণে বিপুল বরাদ্দ না দেখিয়ে কার্যকর বরাদ্দ করেছে রেল। অধীরবাবুও বলেন, “ওঁরা শুধু ঘোষণার পর ঘোষণা করে গিয়েছেন। এক পয়সাও বরাদ্দ করেননি। উল্টে যা বরাদ্দ হয়েছে, রাজ্যের অসহযোগিতায় তা-ও ফিরে এসেছে!”
তিনি নিজে কতটা করেছেন এ রাজ্যের জন্য? তৃণমূলের আক্রমণের জবাবে অধীরবাবু বলেন, “বাংলার রেল প্রকল্পগুলির জন্য যথাসাধ্য করেছি। শেষ মুহূর্তে লড়াই করে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো করিডরের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ আদায়ও করেছি।” এর পরেই সরাসরি তাঁর চ্যালেঞ্জ, “কর্নাটক, রাজস্থানের মতো রাজ্যগুলি রেলপ্রকল্প পাওয়ার জন্য বিনা পয়সার জমির ব্যবস্থা করছে। পশ্চিমবঙ্গ সেটা দিয়ে দেখাক। তা হলে আমি যে ভাবে হোক পশ্চিমবঙ্গের জন্য অতিরিক্ত বরাদ্দ নিয়ে আসব। যে রাজ্য সরকার মেট্রো প্রকল্পের জন্য সামান্য পাইপলাইন সরাতে পারে না, তারা কোন মুখে বঞ্চনার অভিযোগ তুলছে?” এক দিকে কেন্দ্রীয় বঞ্চনা অন্য দিকে রাজ্যের জন্য যথাসাধ্য করার দাবি এই দুইয়ের মাঝে কিছুটা ফাঁপড়েই বামেরা। সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরির অবশ্য কটাক্ষ, “এর আগে তৃণমূল শুধু ঘোষণাই করে গিয়েছে, কোনও টাকা দেয়নি! আর এ বার টাকাও নেই, ঘোষণাও নেই!” এসইউসি সাংসদ তরুণ মণ্ডলের কথায়, “ক্যানিং থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত রেললাইনের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলাম। কিন্তু কিছু করা হয়নি।” আরএসপি সাংসদ প্রশান্তকুমার মজুমদার বলেন, “বালুরঘাট থেকে কলকাতা যাওয়ার জন্য সন্ধ্যার ট্রেন চেয়েছিলাম। কিন্তু তা দেখা গেল না।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.