সেই ভোটের রাজনীতিতেই বন্দি বনশল
রোগনির্ণয় হল। ওষুধও পড়ল। কিন্তু অর্ধেক মাত্রায়। ফলে প্রশ্ন থেকে গেল রোগ নিরাময় নিয়ে।
দীর্ঘ ১৭ বছরের অপেক্ষার পর আর্থিক ভাবে অসুস্থ রেলকে সুস্থ করে তোলার সুযোগ পেয়েছিল কংগ্রেস। কিন্তু সেই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারলেন না রেলমন্ত্রী পবন বনশল। অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মতো রেলের রোগ খুঁজে বার করলেও, সম্পূর্ণ ওষুধ প্রয়োগ করতে যে রাজনৈতিক সাহস প্রয়োজন, তা আজ দেখাতে ব্যর্থ হলেন তিনি। লালুপ্রসাদ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো পূর্বসূরিদের ধাঁচেই রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার পথে হাঁটলেন বনশল। প্রধানমন্ত্রী এবং যোজনা কমিশনের বরাভয় সত্ত্বেও সরাসরি ভাড়া বৃদ্ধির ‘তেতো ওষুধ’ খাওয়ানোর সাহস দেখাতে পারলেন না পঞ্জাব-পুত্তর।
রাজনীতির কারবারিদের মতে কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের চাপেই শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে আসতে বাধ্য হলেন রেলমন্ত্রী। তাতে ভোটের আগে আমজনতার মন হয়তো জয় করা গেল। কিন্তু অর্থের অভাবে বড় মাপের প্রকল্প ঘোষণা না-হওয়ায় শিল্পমহলের হতাশা চাপা থাকেনি। রেল বাজেট পেশের পরেই মুম্বইয়ের শেয়ার সূচক সেনসেক্স পড়েছে ৩১৬ পয়েন্ট।
রেল বাজেট পেশ করতে চলেছেন নিজের দফতর থেকে। মঙ্গলবার সকালে রেলমন্ত্রী পবন বনশল, নয়াদিল্লিতে।
তবে রেলকর্তাদের অনেকের মতে, পবন বনশল সংস্কারের পথে হাঁটতে শুরু করেছেন। দশ বছর ধরে যে কাজ হয়নি, তা এক বাজেটে করে ফেলা সম্ভব নয়। মাত্র এক মাস আগে রেলের সব শ্রেণিতে ভাড়া বাড়ানোর সাহস দেখিয়েছেন তিনি। এ বার বাজেটেও বনশল বাস্তববাদী। যাত্রী ভাড়া না-বাড়ালেও রেলের আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই প্রকল্প ঘোষণা করেছেন।
কিন্তু ভাড়া বাড়ানোই যে রেলের বেহাল আর্থিক দশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ, তা স্বীকার করেছেন বনশল। তাঁর কথায়, “রেল চালানোর খরচ বাড়লেও ভাড়া বাড়েনি। ফলে ক্ষতি খানিকটা সামাল দিতে বার বার পণ্য মাসুল বাড়াতে হয়েছে। ভাড়া না-বাড়ানোয় রেল নিজস্ব আয় হারিয়েছে। তার ফলে টাকার অভাবের কারণে নতুন ক্ষেত্রে লগ্নি করা যায়নি।” যে সব ক্ষেত্রের মধ্যে অন্যতম পরিষেবা ও সুরক্ষা।
বাজেট নথি বলছে, দশ বছরে যাত্রিবাহী ট্রেন বেড়েছে প্রায় ৪ হাজার। আর তার সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে যাত্রী পরিবহণে ক্ষতি। দশ বছর আগে যাত্রী পরিবহণে ক্ষতি যেখানে ছিল প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। তা এখন বেড়ে হয়েছে সাড়ে চব্বিশ হাজার কোটি টাকা। জানুয়ারিতে ভাড়াবৃদ্ধির ফলে অতিরিক্ত ৬ হাজার কোটি টাকা আয় হলেও সেই লাভের গুড় খেয়ে গিয়েছে ডিজেলের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধি। বাজেটে ভাড়া না-বাড়ানোয় রেলের ঘাড়ে আসতে চলেছে আরও সাড়ে আটশো কোটি টাকার বোঝা।
যাত্রী ভাড়ার ঘাটতি পূর্বসূরিদের মতো পণ্য মাসুল দিয়েই সামলাতে চেয়েছেন বনশল। মাসুল বাড়িয়েছেন প্রায় ৬ শতাংশ। কিন্তু রেলে পণ্য পরিবহণের খরচ তুলনায় বেশি হওয়ায় এমনিতেই সড়ক পথে মাল নিয়ে যাওয়ার ঝোঁক ক্রমশ বাড়ছে। পণ্য পরিবহণের পরিমাণ কমছে রেলে। এই মাসুলবৃদ্ধি তা আরও কমাতে পারে বলে রেল মন্ত্রকের অনেকের আশঙ্কা। টিকিট সংরক্ষণ বা বাতিলের মতো ক্ষেত্রগুলিতে কিছু সারচার্জ বসিয়ে ঘুরপথে আয়বৃদ্ধির উপায় বার করেছেন বনশল। কিন্তু তাতে যে কাজের কাজ হবে না, সেটা স্পষ্ট। তাই আজ পূর্ব ঘোষিত প্রকল্পে কাটছাঁট করেছেন রেলমন্ত্রী। ৬৭টি নতুন ট্রেনের ঘোষণা করলেও আগামী আর্থিক বছরে লক্ষ্যমাত্রা কমেছে নতুন লাইনের বিস্তার, গেজ পরিবর্তন, ডাবলিংয়ের ক্ষেত্রে। আর্থিক দৈন্যের কারণে চলতি বাজেটে মন্ত্রকের আনুকূল্য পেয়েছে ৩৪৭টি প্রকল্প।
বাজেট পেশ হওয়ার আগে লোকসভায় বনশলের পরিবার।
দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী যোজনায় প্রতি বছর প্রায় একুশ হাজার কোটি টাকা নিজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে রেল। কিন্তু বনশল নিজেই বলছেন, “এ বছর নিজস্ব আয় হবে মাত্র দশ হাজার কোটি টাকা।” ফলে লালুপ্রসাদ-মমতার মতোই পবনও উত্তরসূরির ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে বলেছেন, “এর পরে যিনি রেলমন্ত্রী হবেন, তাঁকে চার বছরে প্রায় ৯৫ হাজার কোটি জোগাড় করতে হবে।”
কিন্তু প্রশ্ন হল, ওই বিপুল অর্থ আসবে কোথা থেকে? রেল সূত্রে বলা হচ্ছে, আজ যাত্রিভাড়া না-বাড়ালেও ভাড়া ঠিক করার বিষয়টি ইতিমধ্যেই রেল ট্যারিফ অথরিটি গঠন করে তার হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বনশল আজ জানান, অথরিটি গঠনের বিষয়টি আপাতত আন্তঃমন্ত্রক আলোচনার স্তরে রয়েছে। আগামী মাস দুয়েকের মধ্যে তা কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সামনে পেশ করা হতে পারে বলে রেল মন্ত্রক সূত্রে খবর। যদিও এ ব্যাপারে সন্দিহান অনেকেই।
রেল কর্তাদের অনেকে অবশ্য এই আশঙ্কা উড়িয়ে বলছেন, অথরিটি গঠনের পরে তাদের সুপারিশ মতো রেল ভাড়া বাড়ানো হতেই পারে। যার দায় প্রত্যক্ষ ভাবে রেলমন্ত্রী তথা কংগ্রেসের উপর বর্তাবে না। বিরোধী নেতাদের মতে, ভবিষ্যতে ভাড়া বাড়িয়ে লোকসভা ভোটের ঠিক আগে ভোট অন অ্যাকাউন্টে তা আংশিক প্রত্যাহার করে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার কৌশল নিতে পারে কংগ্রেস।
চলতি দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) এক লক্ষ কোটি টাকা রেলের ঘরে আসবে বলে আশা করেন বনশল। কিন্তু মমতার সময় থেকেই পিপিপি মডেল কার্যত ব্যর্থ। ফলে এক বছরে পিপিপি-র মাধ্যমে ৬ হাজার কোটি, বাতিল ছাঁট লোহা বিক্রি করে সাড়ে চার হাজার কিংবা, রেলের জমিকে বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করে এক হাজার কোটি টাকা তোলার যে স্বপ্ন পবন বনশল দেখছেন, তা কতটা সফল হবে, তা নিয়ে দ্বিধায় রেলকর্তারাই।

ছবি: পিটিআই।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.