প্রবন্ধ...
রাজনীতি, পুলিশ, প্রশাসন, এবং গুন্ডারা
জ ২৭ ফেব্রুয়ারি। না, দু’হাত জোড় করে সর্বগ্রাসী আতঙ্ক মাখা সেই কুতুবুদ্দিন আনসারিকে নিশ্চয় আজ আর দেখা যাবে না। কিন্তু ২০০২-এর ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতিটি বছরের এই দিনটিতে কুতুবুদ্দিন আনসারিদের সেই অতলান্ত আতঙ্কের দুঃসহ স্মৃতি ফিরে ফিরে আসবেই।
২০০২-এর ২৭ ফেব্রুয়ারি গোধরায় সবরমতী এক্সপ্রেসের কামরায় জীবন্ত দগ্ধ ৫৮ জনের কথা, তার ‘প্রতিক্রিয়ায়’ গুজরাত জুড়ে সংখ্যালঘু নিধনের কথা, সেই হত্যালীলা ছাপিয়ে কুতুবুদ্দিনদের কথা প্রায় সকলেরই জানা। বরং আজ, সবরমতী এক্সপ্রেসের সেই পোড়া কামরা ভেদ করে যদি আর একটু গভীরে নজর ফেরাই? যদি দেখার চেষ্টা করি, কী ভাবে হিংসার বীজ বপন হয়? সেই বপনকালে কী ভাবেই বা শামিল হন রাজনীতিক, পুলিশ আর প্রশাসন?
এই সন্ধানে আমরা ওয়ার্ড বেরেনস্কট-এর সাহায্য নেব। তিনি গবেষক, কাজ করেন হল্যান্ডে। দীর্ঘ দিন ধরে গুজরাত ‘দাঙ্গা’র সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কার্যকারণের সন্ধান করতে গিয়ে তিনি খুঁজে পেয়েছেন বহু খুঁটিনাটি বিষয়, চমকপ্রদ নানা ঘটনা, যার অনেকগুলিই আমাদের পরিচিত মনে হয়।
আমদাবাদের কাছে একটি ছোট শহর। সেখানকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দশ বছরের এক বালককে প্রতিবেশীর রুপোর গয়না চুরির অভিযোগে পুলিশ ধরে। তার ঠাকুমাকে পুলিশ বলে, ২৫ হাজার টাকা দিলে তারা তাঁর নাতিকে বাঁচিয়ে দেবে। বৃদ্ধা প্রথমে রাজি হলেও পরে পিছিয়ে আসেন। ক্ষুব্ধ পুলিশকর্মীরা তাঁকে লাঠি দিয়ে বেধড়ক মেরে বেশ কয়েকটি হাড় ভেঙে দেয়। মারের চিহ্ন বাইরে থেকেও বোঝা যাচ্ছিল। বিপাকে পড়ে পুলিশ তাঁর বদলে অন্য এক বৃদ্ধাকে কোর্টে হাজির করে। অভিযুক্ত বালকের ঠাকুমাকে বসিয়ে রাখা হয় কোর্টের বাইরে পুলিশ ভ্যানে।
এই সময়েই চিত্রনাট্যে পুরসভার কাউন্সিলর, স্থানীয় কংগ্রেস নেতার প্রবেশ। স্থানীয় এক ‘গুন্ডা’র আত্মীয় ওই বৃদ্ধা। নির্বাচনের তিন বছর পরে সেই বাহুবলীর ফোন নেতাকে। সেই নির্বাচনের দিন সে কংগ্রেসের দলীয় পতাকা, ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে গন্ডগোল বাঁধিয়েছিল। যদিও ওই নেতারই হস্তক্ষেপে ওই বৃদ্ধার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা হয়।
বৃদ্ধাকে নিয়ে নেতা থানায় যান অভিযুক্ত পুলিশের বিরুদ্ধে এফ আই আর করতে। পুলিশ প্রথমে সহকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিতে চায়নি। পরে ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারের কথায় তা নেওয়া হয়। খবর পায় মিডিয়াও। প্রচার চলে। সাসপেন্ড হতে বসেন অভিযুক্ত সাব ইনস্পেক্টর। তবে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় থাকায় তাঁকে সাসপেন্ড না করে তড়িঘড়ি বদলি করে দেওয়া হয়। চিকিৎসার পরে ওই বৃদ্ধা সুস্থ হয়ে ওঠেন। ঘটনা সেখানেই মিটে যায়। অন্তত, ওই নেতা তাই ভেবেছিলেন।
এর কয়েক মাস পরে ওই কংগ্রেস নেতার সঙ্গে বিমানবন্দরে ওই পুলিশ অফিসারের দেখা। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘চিনতে পারেন? আমার সাসপেনশনের জন্য আপনি অনেক চেষ্টা করেছিলেন?’ নেতার মনে পড়ে যায় সে কথা। ওই অফিসার তাঁকে জানান, স্থানীয় আর এক কংগ্রেস নেতা এবং সেই বাহুবলীই তাঁর হয়ে ‘ব্যবস্থা’ করেছেন। তাঁকে নিয়ে ওই বৃদ্ধার কাছে গিয়েছেন। সব কিছু ‘ম্যানেজ’ হওয়ায় তাঁকে সাসপেন্ড না করে স্রেফ বদলি করা হয়েছে।
বেরেনস্কটের কাছে কংগ্রেসের ওই নেতা নিজেই এই কাহিনি শুনিয়েছেন। এ ব্যাপারে বেশ মোটা অঙ্কের লেনদেন হয়েছে বলে তিনি মনে করেন এবং নিজেকে বঞ্চিত বলে ভাবছেন তিনি! কারণ, তিনিই সব কিছু করেছেন, আর ওই বৃদ্ধা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরের এত সব ঘটনা তিনিই জানতে পারলেন না!
এ এক জটিল সমীকরণ স্থানীয় রাজনীতিক, গুন্ডা আর পুলিশ-প্রশাসনের! ছবিটা খুবই পরিচিত। নিজেদের মধ্যেকার বিরোধ দূরে সরিয়ে রেখে এ ভাবেই তো রাজনীতিক-দুষ্কৃতী আর প্রশাসন পরস্পরের কাছাকাছি আসেন!
ওই এলাকারই আর একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন বেরেনস্কট। এটিও গোধরা-পরবর্তী ঘটনা। মুখ্য চরিত্র এক স্থানীয় গুন্ডা (লেখক বলছেন, ‘গুন্ডা’র কোনও ভাল প্রতিশব্দ হয় না)। সেই গুন্ডাটি এলাকায় মদ সরবরাহ করতেন, গুজরাতে যা নিষিদ্ধ। ২০০২-এ গুজরাতে বিধানসভা নির্বাচনের দিন তিনি স্থানীয় বিধায়কের হয়ে একটি পোলিং বুথ দখল করেন। বেরেনস্কটকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, নির্বাচনী প্রচারের জন্য বিধায়ককে তিনি অনেক টাকাও দিয়েছেন। কারণ, তিনি জানতেন, জিতলে নিজের মদের ব্যবসায় তাঁর সাহায্য পাবেন। কথা রেখেছিলেন বিধায়ক। নির্বাচনে জেতার পরে পুলিশের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন ওই গুন্ডাকে। একাধিক বার।
বেরেনস্কট গুন্ডাটিকে প্রশ্ন করেছিলেন, বিধায়কের কথা পুলিশ শুনল কেন? সাফ উত্তর: ‘কারণ, না শুনলে ওই অফিসার অন্য জায়গায় বদলি হয়ে যাবেন।’ প্রসঙ্গত, ওই জায়গাটিতে পোস্টিংয়ের জন্য বিধায়ককে ওই অফিসারও প্রচুর টাকা দিয়েছিলেন!
ওখান থেকে একটু বাইরে আর একটি অঞ্চল। সেখানে কিছু হিন্দু পরিবার থাকলেও সংখ্যালঘুদের সংখ্যাই বেশি। দাঙ্গার সময় এখানেও সেই বিধায়কের উপস্থিতির কথা জানিয়েছেন বেরেনস্কট। কী ভাবে? ২০০২-এর ১ মার্চ ওই অঞ্চলে জড়ো হয় প্রায় দু’হাজার মানুষের জনতা। সেই ভিড়ে বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের স্থানীয় নেতারাও ছিলেন। আরও ছিল স্থানীয় দুষ্কৃতীরাও। অনেকেরই মাথায় গেরুয়ারঙা ফেট্টি ছিল। হাতে ছিল তরোয়াল, ত্রিশূল আর প্লাস্টিকের বোতলে পেট্রল। বস্তির দিকে সেই উন্মত্ত জনতা এগোচ্ছিল। এই সময়েই জিপ নিয়ে এক পুলিশ অফিসার সেখানে হাজির হন। না, জনতাকে ঠেকাতে নয়, বরং তাঁর জিপের পেট্রলই দাঙ্গাকারীদের বোতলে ভরা হচ্ছিল। গোটা বসতি জ্বলে খাক হয়ে যায়।
এই ঘটনার পরে, স্থানীয় এক সমাজকর্মী বেশ কয়েক বার ব্যর্থ হওয়ার পর কোনও মতে থানায় এফ আই আর করতে সমর্থ হন। সেখানে পুলিশের ওই সাব ইনস্পেক্টরের নাম করে তিনি লেখেন, ওই অফিসার পেট্রল বিলি করেছেন। দাঙ্গাকারীদের ধরার পরিবর্তে পুলিশ উল্টে ওখানকার ১২-১৫ জন দরিদ্র মানুষকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। ওই সমাজকর্মীর অভিযোগ ছিল, বিধায়ক পেট্রল বিলিতে সাহায্য করেছেন এবং দাঙ্গায় মদত দিয়েছেন। কারণ, ওখানকার বাসিন্দারা তাঁকে ভোট দেন না বলে তাঁর রাগ ছিল। সেখানে নতুন একটি কলোনি করার জন্য প্রায় পাঁচ বছর আগে থেকেই তাঁর পরিকল্পনা ছিল।
বেরেনস্কট তাঁর পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণার সাহায্যে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন, কী ভাবে রাজনীতি, প্রশাসন আর দুষ্কৃতীরা হাতে হাত মিলিয়ে একাকার হয়ে যায়। কি সংখ্যালঘু নিধন, কি দলীয় সংঘর্ষ, কি অন্য ধরনের সংঘাত বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভাবে সেই ‘বেরাদরি’ হিংসার সমিধ সরবরাহ করে। আমরা এই দুরাচারকে চিনি। হাড়ে হাড়ে চিনি। যখন ঘরের কাছে কলেজ নির্বাচনে হিংসার বলি হন পুলিশকর্মী, যখন কান কেটে, চোখ কার্যত উপড়ে নিয়ে ‘সবক’ শেখাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্তের গন্ধ পাওয়া জনতা, তখন দেখতে পাই এই দুষ্টচক্রের ভয়ঙ্কর রূপ।

রায়ট পলিটিক্স, ওয়ার্ড বেরেনস্কট। রেনলাইট/রূপা


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.