|
|
|
|
সাক্ষাৎকার ... |
শিল্প নেই, তাই বিকল্প কম,
তাই মানুষ জমি আঁকড়ে আছেন, তাই শিল্প হচ্ছে না |
এটাই পশ্চিমবঙ্গের কঠোর বাস্তব। এই বিষচক্র থেকে তাকে উদ্ধার করার দায়িত্ব
নিতে হবে রাজ্য সরকারকেই।
একান্ত সাক্ষাৎকারে জানালেন লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এ
অর্থনীতির শিক্ষক মৈত্রীশ ঘটক। সাক্ষাৎকার নিলেন অমিতাভ গুপ্ত। প্রথম পর্ব। |
সম্প্রতি একটি আলোচনাসভায় আপনি বলেছেন, অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে জমির দাম বাড়লে হয়তো আগের চেয়েও কম জমি পাওয়া যাবে। এই কথাটা রীতিমত অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।
আমি বলছি এই রকম সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এমন নয় যে দাম বাড়ালে সব সময়ই জোগান কমবে। আসলে এই কথাটি জমির বাজার নিয়ে একটা বৃহত্তর বক্তব্যের একটা অংশ। জমির বাজার ঠিক আর পাঁচটা বাজারের মতো নয় যে ‘ফেলো কড়ি, মাখো তেল এবং তেল না পেলে আরও কড়ি ফেলো’ এই সরল যুক্তিতে চলে। সিঙ্গুরে যখন শেষ পর্যন্ত জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়াটি ভেস্তে গেল, আমি এবং আর কয়েক জন অর্থনীতিবিদ সেখানে একটা সমীক্ষা করেছিলাম। আমরা দেখার চেষ্টা করেছিলাম, কত দাম পেলে মানুষ জমি বেচে দিতে রাজি হবেন। আমরা যখন সিঙ্গুরে কৃষিজীবী মানুষের সঙ্গে কথা বলি, জমির চরিত্র সম্বন্ধে কয়েকটা কথা স্পষ্ট হয়েছিল। জমি শুধুমাত্র একটা প্রডাকটিভ অ্যাসেট অর্থাৎ উৎপাদনশীল সম্পদ নয়। জমি বড় ধরনের আর্থিক নিরাপত্তা। সোনা থাকলে চুরি হয়ে যেতে পারে, কিন্তু জমি চুরি যাওয়া কঠিন। আমাদের এখানে জমির বাজার যে রকম ঘেঁটে আছে, তাতে দুম করে জমির মালিকানা পাল্টে ফেলাও কঠিন। জমির যা দাম, জমি বেচে দিয়ে যদি তার চেয়ে অনেক বেশি টাকাও পাওয়া যায়, সেই টাকা হাতে রাখার অনেক রকম মুশকিল আছে। ছেলে বাইক কিনবে, অন্য ভাবেও টাকা বাজে খরচ হয়ে যাবে। মূল্যস্ফীতির সমস্যা আছে। জমি যাকে বলে ইনফ্লেশন-প্রুফ অ্যাসেট। আর একটা বড় ব্যাপার হল, জমি থেকে খাদ্য উৎপন্ন হয়। শুধু ভারতেই নয়, গোটা দুনিয়াতেই যাঁরা মূলত কৃষির ওপর নির্ভরশীল, এবং একটা ছোট গণ্ডির মধ্যে বসবাস করেন তাঁদের মধ্যে বাইরের বৃহত্তর দুনিয়া সম্বন্ধে এক ধরনের অবিশ্বাস কাজ করে। নিজের খাবারের ব্যবস্থাটুকু নিজের হাতে করে নিতে পারা তাঁদের কাছে বড় নিরাপত্তা। জমি নিজেও একটা বড় নিরাপত্তা মানুষ জানেন, বিপদে পড়লে, চিকিৎসার জন্য, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া বা বিয়ের জন্য জমি বেচে টাকা পাওয়া যেতে পারে। তাঁরা সেই কারণেও জমি হাতে রাখতে চেষ্টা করেন।
সমীক্ষায় পাওয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করে আমরা একটা মডেল তৈরি করেছি। তার খুঁটিনাটি বিশ্লেষণের মধ্যে এখানে যাচ্ছি না। মূল কথাটা বলি। জমির ব্যবহারকে দুটো ভাগে ভাগ করে নেওয়া যায় এক, রোজগারের জন্য; দুই, নানান নিরাপত্তার জন্য। জমির দাম যত কম হবে, নিরাপত্তার জন্য তত বেশি জমি হাতে রাখতে হবে কম দামে বেচলে প্রয়োজনীয় টাকা তোলার জন্য বেশি জমি বেচতে হবে, তাই। যাঁরা নিতান্ত গরিব, তাঁরা বাজারে জমির দাম কম থাকলে এই দ্বিতীয় ব্যবহারের জন্য জমি হাতে রাখতেই পারেন না। এমনকী, মাঝারি চাষিরাও পারেন না। ফলে, যতটুকু জমিতে তাঁরা চাষ করেন, ততটুকুই তাঁরা হাতে রাখেন। এ বার, জমির দাম যত বাড়বে, তত অল্প জমিতেও নিরাপত্তার কাজ হবে। ফলে, অনেকের পক্ষেই ‘নিরাপত্তার জমি’ ধরে রাখা সম্ভব হবে। খেয়াল করার, জমির যত দাম বাড়বে, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর কৃষকের পক্ষেও জমি ধরে রাখা সম্ভব হবে। ফলে, জমির দাম বাড়লে জোগান কমতেই পারে। অর্থনীতির ভাষায়, জমির সাপ্লাই কার্ভ দামের একটা পরিসরের ক্ষেত্রে ব্যাকওয়ার্ড বেন্ডিং। |
|
এখন যাঁরা ধনী কৃষক, অর্থাৎ যাঁদের হাতে এখনই বিক্রি করার মতো জমি আছে, জমির দাম বাড়লে নিরাপত্তার জন্য তাঁদের তো আরও কম জমি হাতে রাখলেই চলে। তাঁরা কি নিজেদের উদ্বৃত্ত জমি বেচে দেবেন না? তাতে জমির জোগান বাড়বে না কি?
যাঁরা ধনী কৃষক এবং যাঁদের হাতে বিক্রি করার জন্যে এখনই উদ্বৃত্ত জমি আছে, জমির দাম বাড়লে তাঁদের দিক থেকে জমির জোগান বাড়বে, প্রথাগত অর্থনীতির যুক্তিতেই। কিন্তু নীট ফল কী হবে তা জমির মোট পরিমাণ দিয়ে নির্ধারিত হবে না, জমির বণ্টনের ওপর নির্ভর করবে। পশ্চিমবঙ্গের সীমিত ভূমিসংস্কার এবং জমিতে জনসংখ্যার চাপ, এই দুই কারণের ফলে ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক কৃষকের সংখ্যা বেশি, তাই জমির জোগান কম হওয়া এবং দাম বাড়লে সমস্যার সমাধান না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আমাদের সমীক্ষার নমুনায় দেখছি, জমি বেচার সিদ্ধান্ত তিনটে বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। এক, যে পরিবারের হাতে জমির পরিমাণ যত কম, জমি বেচায় তারা তত বেশি অনিচ্ছুক। দুই, যে পরিবারের সদস্যরা মূলত কৃষিক্ষেত্রেই কাজ করেন, অর্থাৎ যে পরিবার কৃষির ওপর যত বেশি নির্ভরশীল, তাঁরা জমি বেচতে তত বেশি অনিচ্ছুক। তিন, কমবয়সিরা জমি বেচতে অপেক্ষাকৃত ভাবে বেশি ইচ্ছুক। প্রথমটা কেন হয়, তার কারণ আগেই বললাম। দ্বিতীয় ঘটনাটি কেন ঘটে, অর্থাৎ মূলত কৃষির ওপর নির্ভরশীল পরিবার জমি বেচতে কেন অনিচ্ছুক? কারণ কৃষিই তাঁদের একমাত্র মানবসম্পদ। ভেবে দেখলে, কেউ যদি আমায় বলে যে অনেক টাকা দেব কিন্তু তুমি আর কোনও দিন বই পড়তে পারবে না, লিখতে পারবে না, কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারবে না আমি কি সেই অনেক টাকার বিনিময়ে এই জিনিসগুলো ছেড়ে দেব? আমার ক্ষেত্রে বই, কম্পিউটার যা, কিছু কৃষিজীবী পরিবারের ক্ষেত্রে জমি ঠিক তাই আমরা সারা জীবন ধরে শুধু এই জিনিসগুলোই ব্যবহার করতে শিখেছি। যাঁদের বয়স কম, খানিক পড়াশোনা আছে এবং কৃষির বাইরের জগতের সঙ্গে পরিচয় আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা কম তাঁরা বিকল্প পেশার কথা ভাবতে পারেন।
কমবয়সিরা অপেক্ষাকৃত সহজে জমি বেচতে রাজি হবেন, এটা তো খানিকটা প্রত্যাশিতই। এবং, সম্ভবত ভাল খবরও বটে।
হ্যাঁ, কিন্তু তরুণ প্রজন্মের সামনে যদি আরও বেশি বিকল্পের রাস্তা খোলা থাকত, তা হলে তাঁরা আরও কম জমি আঁকড়ে থাকতে চাইতেন। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যদি তরুণরা দেখতেন যে তাঁদেরই মতো ছেলেমেয়েরা, তাঁদের বন্ধুবান্ধবরা কোনও প্রশিক্ষণ নিয়ে ভাল চাকরি পেয়েছে, চাষ করার চেয়ে ভাল ভাবে আছে, তবে তাঁরা অনেক বেশি করে সেই পেশায় যেতে চাইতেন। পশ্চিমবঙ্গে সেই সুযোগ, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, নেই। এখানে একটা বিষচক্র কাজ করছে শিল্প হচ্ছে না বলে বিকল্প কম, বিকল্প কম বলে জমির ওপর নির্ভরতা প্রবল, আর তাই শিল্প হচ্ছে না।
এই ক্ষেত্রে তো সরকারের দায়িত্ব অনেকটাই। যেমন, এই ছেলেমেয়েদের জন্য চাকরির বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প তৈরি করা, যাঁদের জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে, তাঁদের জন্য স্বাস্থ্য বিমার ব্যবস্থা করা... হয়তো এমন একটা ব্যবস্থাও করা যায়, যেখানে জমি দিলে একটা পরিচয়পত্র পাওয়া যাবে, যেটা থাকলে ব্যাঙ্ক বিনা বন্ধকে ঋণ দেবে। সেই ঋণের জামিন থাকবে সরকার।
সে তো বটেই। সরকারের দায়িত্ব একেবারেই অপরিহার্য। আর পাঁচ জন ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না। কিন্তু সরকার পায়, অন্তত পাওয়ার কথা। এবং, ভবিষ্যতের থেকে ঋণ নিয়ে আজকে খরচ করার অধিকার একমাত্র সরকারেরই আছে। কাজেই, সরকারের স্যোশাল আরবিট্রেটরের ভূমিকা নেওয়ার কথা। যে ব্যবস্থাগুলো করলে মানুষ জমি ছাড়তে স্বচ্ছন্দ হবেন, সেগুলো সরকারকে করতে হবে। রাজকোষের টাকা খরচ করেই। শিল্প হলে সেই টাকা পুষিয়ে যাবে। কিন্তু তার জন্য এক দিকে রাজকোষে টাকা থাকতে হবে, অন্য দিকে সরকারের খানিক সদিচ্ছাও থাকতে হবে।
|
(চলবে) |
|
|
|
|
|