ইতিহাস, তথা ‘ইতি হ আস’, অতীতের বস্তু। বর্তমানের নহে। কথাটি বলিতে সহজ হইলেও বুঝিতে কঠিন। অন্তত ভারতীয়দের পক্ষে। তাহারা বারংবার ইতিহাসকে অকারণ বর্তমান কালের মধ্যে টানিয়া আনিবার চেষ্টা করে, বর্তমানের দুঃখ-দুর্দশার বাস্তব হইতে পলায়ন করিয়া ইতিহাসের কোলের মধ্যে নিজের বিড়ম্বিত মুখটি লুকাইতে চায়। ভুলিয়া যায় যে, ইতিহাস বেচারির কোলখানি প্রশস্ত হইলেও দুঃখ-উপশমকারী ক্ষমতা তাহার নাই। দীর্ঘ যুগব্যাপী সংঘটিত কোনও অন্যায়ের ক্ষতে হয়তো-বা সে তাহার মলিন আঁচলটি বুলাইয়া কিছু প্রতিকার করিলেও করিতে পারে, কিন্তু নানাবিধ একক ঘটনাকে আলাদা করিয়া তুলিয়া ধরিয়া তাহার কাছে সুবিচারের আশায় দৌড়াইলে সে আশা পূরণ তাহার ক্ষমতায় কুলাইবে না। দেখা যায়, ব্রিটিশ রাজপুরুষরা ভারতে পা দিলেই, ভারতীয়রা নিজেদের শত গ্লানি ভুলিতে প্রাণপণে ইতিহাস আঁকড়াইয়া ঘ্যানঘ্যান করিতেছেন। ঘটনা হইল, ব্রিটিশরা ভারত নামক উপনিবেশটির যে অগণিত সামাজিক বা অর্থনৈতিক হেনস্থার কারণ হইয়াছে, তাহার প্রতিকার হিসাবে ব্রিটেন আজ সুমিত্রতার হাত বাড়াইয়া দিতে পারে, কিন্তু দুইশত বৎসরব্যাপী অসংখ্য সাম্রাজ্যবাদী অনাচারের প্রতিটির জন্য ক্ষমাস্বীকার কিংবা ক্ষতিপূরণ সে করিবে না।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ভারত সফরকালে পঞ্জাবে আসিয়া জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের স্মৃতিতে ‘দুঃখপ্রকাশ’ করিলেন। অমনি হইহই উঠিল: ক্ষমাস্বীকার নহে কেন? হে ভারতবাসী, ক্যামেরন ভদ্র, তাই তিনি এইটুকু করিয়াছেন। এইটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকা ভাল। অধিক দিন নহে, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্বামী প্রিন্স ফিলিপ ভদ্রতার ধার ধারিতেন না বলিয়া সপাটে কহিয়া দিয়াছিলেন, ওই ঘটনার ‘রিপোর্টিং’ ভুল, নিশ্চিত ভাবেই অত লোক সে দিন নিহত হন নাই! হে ভারতবাসী, কেবল জালিয়ানওয়ালাবাগ-ই তো নহে, আরও অসংখ্য হত্যাকাণ্ড ব্রিটিশ রাজের বদান্যতায় অনুষ্ঠিত হইয়াছে, তাহাদের কয়েকটির গুরুত্ব জালিয়ানওয়ালাবাগের অপেক্ষা বেশি বই কম নহে! ভগত সিংহ নামক জাতীয়তাবাদী যুবাটিকে ফাঁসি দিয়াও ব্রিটিশরা সুকাজ করে নাই। কত দুঃখ-ই বা প্রকাশ করিবেন ক্যামেরন! হিন্দুস্থানের মাটিতে পা দেওয়া ইস্তক যদি ব্রিটিশের যাবতীয় কুকার্যের জন্য তাঁহাকে একাই দুঃখ-বার্তা বিতরণ করিয়া যাইতে হয়, তবে তো ২০১৩-উপযোগী ব্যবসাবাণিজ্য-কথার আর সময়ই থাকে না!
আর, হে ভারতবাসী, ক্ষমাস্বীকারের কেঁচো খোঁড়াও কি সুুবুদ্ধির কাজ? এগারো বছর পূর্বের গুজরাতের গণনিধন, ঊনত্রিশ বছর পূর্বের শিখ-নিধন, কিংবা সাড়ে পাঁচশো বছর পূর্বের মন্দির-লুণ্ঠন, কিংবা হাজার বৎসর পূর্বের লাগাতার বৌদ্ধভিক্ষু-নিধন, কোনও খাতার হিসাবই তো অদ্যাবধি মিলে নাই! বাস্তবিক, ভারতবর্ষের ইতিহাসের যা গতিপ্রকৃতি, তাহাতে প্রতিটি নাগরিকেরই উচিত অপর নাগরিকের সামনে আসিলে লজ্জায় অধোবদন হওয়া। বহু শতকের পাপের সে ভার এমনই বিপুল যে, বদন আদৌ না তোলাই সঙ্গত। ইতিহাস বড় বিপজ্জনক বস্তু। |