একাত্তরে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম ও পার বাংলার পাশে। সে ছিল
অন্য এক শতাব্দী।
এখন ওঁরা আবার লড়ছেন। আমরা উদাসীন, নিশ্চুপ। সোমনাথ মুখোপাধ্যায় |
বাংলাদেশ জুড়ে মুক্তিযুদ্ধ সম্পূর্ণ করার ডাকে রাস্তায় লাখো মানুষ। বাঙালি আবার যুদ্ধে নেমেছে, দলীয় ঝান্ডা ছাড়াই। সেই একাত্তরে যেমন বাঙালি লড়েছিল ধর্মান্ধতার রাজনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, ভাষাগত আধিপত্যের প্রতিকূলে, স্বাধীন দেশের স্বপ্ন সাকার করতে, তেমনই আজ জেগে উঠেছে বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের স্লোগানকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে। প্রায় এক মাস হতে চলা এই আন্দোলন ‘শাহবাগ বিস্ফোরণ’ নামে আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছে। প্রত্যাশিত ভাবেই আর শান্তিপূর্ণ থাকতে পারছে না এই আন্দোলন। ইতিমধ্যে আন্দোলনের এক নেতা রাজীব হায়দার ও বেশ কয়েক জন সক্রিয় কর্মী নিহত হয়েছেন। ওই দেশের ধর্মান্ধরা যে কতটা শক্তিশালী তার প্রমাণ— দেশের প্রায় সর্বত্র একুশে’র উদ্যাপন শেষ হতে না হতেই নেমে এসেছে সশস্ত্র আক্রমণ। আন্দোলনের কেন্দ্রগুলোতে একের পর এক ঝটিকা আক্রমণ সংঘটিত হচ্ছে। গড়ে উঠছে প্রতিরোধ। বাঁশের লাঠি বানিয়ে আবারও ঝাঁপাচ্ছে এ যুগের মুক্তিযোদ্ধা। সকলে মিলে রাস্তায় নেমে মৌলবাদীদের ডাকা হরতাল ব্যর্থ করে দিচ্ছে।
আর সীমান্তের এ দিকে আমরা কী করছি? কী করছে প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ? এখানকার রাজনৈতিক দলগুলো, বা, তথাকথিত নির্দলীয় বুদ্ধিজীবী সমাজ? উনিশশো একাত্তরে বাংলাদেশের পাশে ঝাঁপিয়ে পড়া এ পারের বাঙালি আজ কোথায়? একটিও সমর্থনজ্ঞাপক জমায়েত পর্যন্ত সংগঠিত করতে সমর্থ হয়নি, এখনও পর্যন্ত। অতি সম্প্রতি দু-একটি উদ্যোগের কথা কানে ভেসে আসছে বটে, কিন্তু আরও আগেই কি হওয়া উচিত ছিল না আরও অনেক কিছু? বিশেষত যখন পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতার প্রগতিশীলতার, ধর্মনিরপেক্ষতার মুখে থাপ্পড় মেরে এ শহরেই ঘটে গেছে বাংলাদেশের ঘাতক-দালাল-বিশ্বাসঘাতকদের সমর্থনে বিক্ষোভ প্রদর্শন? সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম কাণ্ডে জেগে ওঠা বাংলার বিবেক কি এক ফোঁটাও দ্রবীভূত হয়নি প্রতিবেশী দেশে বাঙালির চলমান ধর্মযুদ্ধের খবরে? নতুন প্রজন্ম, যাঁদের বলা হয় নেট-প্রজন্ম, নয়া মাধ্যমটিকে ব্যবহার করে এত বড় একটা লড়াই শুরু করল শাহবাগে। আর এখানে? এখানকার নতুন প্রজন্ম কি আদৌ জানে, কী ঘটছে ঢাকায়? |
আমরা অনেক দূরে। ঢাকা, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩। ছবি: এ এফ পি |
এই বাংলার মানুষ নাকি খুব রাজনীতি-সচেতন। বাঙালি এই নিয়ে বেশ আত্মগর্বী। কেমন সেই রাজনীতি-সচেতনতা? এই যেমন, বাঙালি সিপিআই(এম), কংগ্রেস, তৃণমূল ইত্যাদি রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মী বা সমর্থক। সব কিছুই এখানে বিচার করা হয় পতাকার রং দেখে। সবাই জানে যে, এ বঙ্গে দলীয় প্রশ্রয় ও উসকানি ছাড়া কিছুই হতে পারে না। এই সর্বময় দলাদলি এবং তার খেউড়সুলভ চর্বিতচর্বণই বাঙালির বহুল প্রচারিত রাজনীতি-সচেতনতার প্রকৃত চিত্র।
সেই নানা রঙের ঝান্ডাধারী রাজনৈতিক দলগুলো শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে নীরব কেন? কোথায় তাঁদের বিখ্যাত মতাদর্শ আর আন্তর্জাতিকতা? অন্য দিকে মা-মাটি-মানুষের মন্ত্র জপা দলটিই বা কেন নির্বাক দর্শক? বাংলাদেশের মা-মাটি কি এই বাংলার থেকে এতই আলাদা? ওখানকার মানুষ যে ধর্মীয় মতান্ধতা এবং বিষাক্ত রাজনীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে, তা কি মা-মাটি-মানুষকে মুক্ত করার লড়াই নয়?
তবু, কেন এঁরা এতই নিশ্চুপ? স্পষ্ট করেই আজ এই সত্য বলার যে, দলগুলো চুপ, কেন না, সব দলই গোপনে বা প্রকাশ্যে মতান্ধতা, ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় সংকীর্ণতার প্রশ্রয়দাতা। বিজেপি তো না হয় হিন্দুত্বের পূজারি, অন্যান্য তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষদের প্রকৃত মুখ কেমন? মুসলিম মহল্লায় মুসলিম প্রার্থী, দলীয় পদে মুসলিম কোটা, মন্ত্রিত্বেও তা-ই— কোনও দল বলতে পারবে বুক বাজিয়ে যে, তারা এ সব করে না? মকবুল ফিদা হুসেন বা সফদর হাসমি নিয়ে মেতে ওঠা কেন হারিয়ে যায় যখন তসলিমা বিতাড়িত হন বা রুশদি কলকাতায় পা ফেলতেই পারেন না? কয়েকশো ধর্মান্ধ-র আস্ফালনে যখন ধ্যানমগ্ন হয় বাংলার প্রগতিশীলতা, লজ্জায় এক বারও কি মুখ ঢাকে মন্ত্রী-সান্ত্রি, নেতা-নেত্রী, লালবাতিওয়ালা ভিআইপি? না। সব দল চুপ করে থাকে। একদম বোবাকালাকানা। যেন কিছুই ঘটেনি। এখানে ও সব যেন কিছুই ঘটে না। চুপ করে থাকে, কারণ তারা ভয় পায়। ভোট হারানোর ভয়। ভাবে, ধর্মীয় গুরুদের আলখাল্লায় বাঁধা আছে লাখো লাখো ভোট মেনে নাও, অতএব, তাঁদের সব আবদার, গুন্ডামি, হুমকি এবং খবরদারি।
আর সুশীল সমাজ? অধুনা যাঁদের ডাকা হচ্ছে বিদ্বজ্জন বলে! তাঁরাও কি ‘পলিটিকালি কারেক্ট’ থাকার সুগভীর মৌন’য় রয়েছেন আত্মগোপনে, নির্বাসনে? চরাচর জুড়ে কেন এত শিল্পিত শীতলতা? স্পষ্টবাকের কেন এত ভয়? কীসের-ই বা এই ভয়? ওঁদের তো আর ভোটের ভয় থাকার কথা নয়, তা হলে? তাঁদের ভয়, ক্ষমতার রোষে পড়ার, পুরস্কৃত না হওয়ার, কালো তালিকাভুক্ত হয়ে প্রসাদ থেকে বঞ্চিত হওয়ার। ভয়, দলীয় পৃষ্ঠপোষকতাহীন একঘরে হয়ে যাওয়ার। জোর গলায় নির্ভয়ে ন্যায্য কথা বলতে পারার মতো সর্বজনমান্য মানুষের আজ বেজায় অভাব। তথাকথিত বিদ্বজ্জনদেরও ক্রমাগত পাদপ্রদীপে থেকে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন দলীয় মদত বা বড় কোনও মিডিয়া-হাউসের আশীর্বাদ। রাষ্ট্র কী বলবে, দল কী ভাববে, গণমাধ্যম কী ভাবে নেবে, জনগণমনোমত হবে কি না— এত সব প্রখর চাতুর্যের সঙ্গে বিচার-বিবেচনা করে তবে মুখ খুলবেন তাঁরা। আর যদি হাওয়ার গতি ঠিকঠাক বোঝা না যায়, নেহাতই মূক।
শাহবাগ চত্বরের নতুন নাম ‘প্রজন্ম চত্বর’। সেখানে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা বাংলার ধর্ম রক্ষার্থে পাহারা দেয় নতুন প্রজন্মের বাঙালি। সে ধর্ম মানুষের ধর্ম। হয়তো সাময়িকভাবে জয় হয়েছে মতান্ধতার, বৈরিতার উপাসক অ-ধর্মের। কিন্তু অ-ন্যায়, অ-ধর্ম, অ-নীতি স্থায়ী হয়নি। গৌর-নিতাই, লালন-ফকির, রবীন্দ্রনাথ, রামকৃষ্ণ, নজরুল, জালালুদ্দিনের গভীর প্রেমাদর্শ আর আত্মজিজ্ঞাসা গঠন করেছে যে উচ্চ ধর্মাদর্শ, মানুষে মানুষে, সিনায় সিনায়, বহমান যে নূরাগত রূহ্, মলিনতা পঙ্কিলতা সরিয়ে সে ঝলসে উঠেছে আবার। শাহবাগ তারই প্রমাণ।
আর এই বাংলার নয়া প্রজন্ম? বড়ই উদাসীন। জগৎ-সংসারের কিছুতেই কিছু এসে যায় না। নিছক ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণলক্ষ্যে মগ্ন, পাশের বাড়ির অগ্নিকাণ্ডেও প্রবল নিস্পৃহ। কেন?
বিশ্বায়নের রঙিন লোভ, না কি রাজনৈতিক হয়ে পড়ার ভয়, সর্বময় এক বিশ্বাসহীনতা, না কি দীর্ঘ রাজনীতি-শাসনের নিষ্ক্রিয়তার বদভ্যাসজনিত সুপ্রোথিত উদ্যমহীনতা: না কি এই সব কিছুই একসঙ্গে খেলা করে যায়, এই বাংলার নতুন প্রজন্মের রক্তের ভেতরে?
রাজনীতির কারবারিরা ভোট গোছাতে ব্যস্ত, বিদ্বজ্জন গুছিয়ে যান আখের। এ সব দেখেশুনে তবে আঠারো-পঁচিশ-পঁয়ত্রিশও তাঁদেরই অনুকরণ করবে? ঢাকা লড়ছে শাহবাগে, অ-ধর্ম অ-ন্যায়-এর বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ। কলকাতার নবীন যৌবন কি আরও এক বার, উনিশশো একাত্তরের মতো, বোতাম ছেঁড়া শার্ট গায়ে ঢাকার পাশে দাঁড়াবে না? |