আচমকা ফেটে পড়ে আইএনটিটিইউসি তথা তৃণমূলকে চমকে দিয়েছেন তিনি।
শুধু যে শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু, শ্রমিক নেত্রী দোলা সেন বা আইএনটিটিইউসি-র জেলা সভাপতি প্রভাত চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তোলাবাজির অভিযোগ, তা তো নয়। ধর্মঘটে বাধা দেওয়ায় চিমটি দেওয়া হয়েছে খোদ দলনেত্রীকেও।
যাকে বলে, মৌচাকে ঢিল মেরেছেন পদত্যাগী শ্রমিক নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। আইএনটিটিইউসি-র রাজ্য কোর কমিটি থেকে তিনি ইস্তফা দিতে পারেন। তাতে কী? তৃণমূলের বড় নেতারা সরাসরি আক্রমণে না এলেও এলাকার নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশ ইতিমধ্যেই খড়্গহস্ত। এক দিকে যেমন রাজনৈতিক অতীত নিয়ে টিপ্পনী কাটা হচ্ছে, বাঁকা প্রশ্ন উঠছে তাঁর আসল ‘পরিচয়’ নিয়েও। তার কারণও আছে।
কয়লাখনি এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করে আসা সোমনাথবাবুর বাড়ি উখড়ায়। কিন্তু ভোটার তালিকা খুঁজে ওই নাম পাওয়া যাবে না। বরং উখড়া ৬৫ নম্বর বুথে ১৮১ নম্বরে রয়েছে অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়ের নাম। সোমনাথ ওরফে অরুণবাবুর ব্যাখ্যা, “সত্তরের দশক থেকে আমি সিপিআই (এমএল)-এর হোলটাইমার। আত্মগোপন করার জন্য বারবার নাম বদলাতে হয়েছে। কখনও ‘নবীন’, তো কখনও ‘অমিতাভ’ অনেক নাম নিয়েছিলাম। সোমনাথ নামটাই বেশি প্রচারিত হয়ে যায়।” শুধু নাম তো নয়। বারবার শিবির কেন বদলেছেন, সেই প্রশ্নটাও কিন্তু শিল্পাঞ্চলের রাজনৈতিক মহলে ঘোরাফেরা করছে।
নকশালপন্থীদের একাংশের দাবি, এক সময়ে ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা ভক্তিভূষণ মণ্ডলের ছত্রছায়ায় ছিলেন অরুণ। বীরভূমের খয়রাশোলে রসাবড়া, হজরতপুর ইত্যাদি এলাকায় কয়লা শ্রমিকদের নিয়ে সংগঠন করতেন। সিআইএসএফের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন। মার খান। ভর্তি হন সিউড়ি সদর হাসপাতালে। কয়লা পাচার চক্রেও তাঁর নাম জড়িয়ে যায়। সুস্থ হয়ে বেরিয়ে এর পরেই ‘সোমনাথ’ নাম নেন তিনি। পাল্টে ফেলেন পদবিও। অন্ডালে এসে সিপিআই (এমএল)-এ যোগ দেন। প্রথম দিকে সুনীল পালের ছত্রচ্ছায়ায় ছিলেন। গণেশ পালের সঙ্গেও ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়। পরে নিজে আলাদা দল গড়েন। গড়ে তোলেন সংযুক্ত পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়নও।
হাওয়া বুঝতে কোনও দিনই ভুল হয়নি সোমনাথবাবুর। ১৯৯৮ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে তিনি উখড়া পঞ্চায়েতে ক্ষমতা দখল করেন। ২০০৩ সালে সিপিএমের সঙ্গে জোট বেঁধে ফের ওই পঞ্চায়েতেই ক্ষমতায় আসেন। বছর তিনেক বাদে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে জোট ভেঙে বেরিয়ে সম্পর্ক গড়েন তৃণমূল ও কংগ্রেসের সঙ্গে। ২০০৮-এ তাদের সঙ্গে জোট করেই উখড়া পঞ্চায়েতে দু’টি আসন দখল করেন। ইতিমধ্যে রাজ্যস্তরে সিপিআই প্রভাবিত শ্রমিক সংগঠন এআইটিইউসি-র সঙ্গেও সমঝোতা করে ফেলেছেন তিনি।
এআইটিইউসি-র জেলা নেতা তথা অন্ডাল পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য প্রভাত রায় বলেন, “ছ’বছর আগে বাঁকোলায় প্রকাশ্য সমাবেশে সোমনাথ এআইটিইউসি-তে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু বছরখানেক পরেই দোলা সেন ও পূর্ণেন্দু বসুর নেতৃত্বে সংযুক্ত পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়ন-কে আইএনটিটিইউসি-র অসংগঠিত শ্রমিক পরিবহণ ইউনিয়নের (অল ইসিএল কন্ট্রাক্টর্স লেবার ইউনিয়ন) সঙ্গে মিশিয়ে দেন। দোলা-পূর্ণেন্দুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সৌজন্যে আইএনটিটিইউসি-র রাজ্য কোর কমিটিরও সদস্য হন।” ওই সময়ে দোলাদের সঙ্গে তিনিও তৃণমূলের দিকে ঝুঁকে পড়েন। রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পরেই সিপিআই (এমএল) ছেড়েছিলেন সোমনাথ। কিন্তু এখনও উখড়ায় তাদের ‘মাও ভবনে’ বসেই কাজকর্ম চালান। ক্ষমতার দখল নিয়ে তৃণমূলের পুরনো কর্মীদের গোষ্ঠীর সঙ্গে বিবাদেও জড়িয়েছেন বারবার।
তৃণমূলের সংসারে তাঁর অন্যতম ‘শত্রু’ বলে পরিচিত দলের পাণ্ডবেশ্বর ব্লক সভাপতি নরেন চক্রবর্তী। তাঁর দাবি, “পুলিশের চোখে ধুলো দিতেই উনি ভুয়ো নাম ব্যবহার করে ঘোরাফেরা করেন।” সোমনাথবাবু পাল্টা বলেন, “মলয় ঘটকেরও তো আসল নাম অজিত ঘটক। পূর্ণেন্দু বসুর আসল পদবি ভট্টাচার্য। ওঁরাও তো নাম পাল্টেছেন! শুধু আমার বেলাই প্রশ্ন?” মলয়বাবু অবশ্য হেসেই উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, “অজিত আর মলয় দু’টোই আমার নাম। পরে হলফনামা দিয়ে শুধু মলয় নামটাই রেখেছি। অজিত নাম এখন আর ব্যবহার করি না। ওঁর মতো চারটে নাম নিয়ে তো ঘুরি না!”
এখন সোমনাথবাবুর আয়ের উৎস নিয়েও নানা প্রশ্ন তুলছে তৃণমূল। তাদের প্রশ্ন, উখড়া বাজারে তাঁর বাড়ি-গাড়ি রয়েছে। কর্মসূত্রে কোথাও যুক্ত না থাকা সত্ত্বেও সে সব কোথা থেকে এল? আইএনটিটিইউসি নেতা রামচরিত পাসোয়ানের দাবি, “সংগঠনের নাম করে উনি যথেচ্ছাচার করেছেন।” কংগ্রেস প্রভাবিত আইএনটিইউসি অনুমোদিত কোলিয়ারি মজদুর ইউনিয়নের সম্পাদক তরুণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, “আয়কর দফতর নিরপেক্ষ তদন্ত করলে সব বেরিয়ে যাবে।” সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য তথা সিটু নেতা তুফান মণ্ডল বলেন, “এ সব ওদের লেগেই আছে। ওদের দলই দেখুক তদন্ত করে।” বিজেপি প্রভাবিত বিএমএস-ই শুধু কোনও কটূ কথা বলছে না। তাদের ইসিএল কর্পোরেট ওয়েলফেয়ার কমিটির সদস্য স্বপন চট্টোপাধ্যায় বরং দাবি করেন, “ইদানীং উনি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আমাদের অসংগঠিত শ্রমিক সংগঠনের প্রতিই ওঁর উৎসাহ বেশি। তবে এখনও যোগ দেননি।” সোমনাথবাবু অবশ্য বলেন, “আমার সঙ্গে অনেকে আছেন। সবার সঙ্গে কথা বলে ভবিষ্যৎ পথ ঠিক করব। পুরনো দল সিপিআই (এমএল)-এর সঙ্গে আজও আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আমি আবার সেখানেই ফিরে যেতে পারি।” |