|
|
|
|
‘রাজা’র কথাতেই ভোট দেন নাগা প্রজারা |
রাজীবাক্ষ রক্ষিত • গুয়াহাটি |
দুই দেশেতেই ‘রাজা’ তিনি। তাঁর দরবার বসে ভারতে। আবার শয়নগৃহটি মায়ানমারে। রাজা নেশা করেন মায়ানমারের সেরা আফিমে। আবার আহারে পছন্দ ভারতীয় শূকরের ‘বার-বি-কিউ’। গণতান্ত্রিক ভারতই হোক, কি সামরিক শাসনাধীন মায়ানমার, প্রজারা কাকে ভোট দেবেন তা কিন্তু ঠিক করে দেন রাজাই।
রাজার নাম ন’গো আং। জাতিগত পরিচয়ে নাগা কন্যাক। নাগাল্যান্ডের ১৬টি উপজাতির মধ্যে সব থেকে হিংস্র ছিল কন্যাকরাই। মানুষের কাটা মুণ্ড সংগ্রহ করাই ছিল তাদের গর্বের প্রতীক। তা এখন আর রাজ্যপাটের বালাই নেই। তবু রাজার গলায় শোভে মুণ্ডমালা। দরবারও বসে প্রত্যহ।
মাথা কাটার চিহ্ন হিসাবে কন্যাক বীররা একদা মুখে উল্কি আঁকতেন। উল্কি আঁকার অধিকারী ছিলেন একমাত্র ‘চটাই’ বা প্রধান রানি। খ্রিষ্টধর্ম আসার পরে উল্কি আঁকার প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু কন্যাকরা আজও প্রাণীদেবতা ও যিশুদেবতাকে মিলিয়ে মিশিয়ে ভক্তি করেন। নাগা লোংগওয়ার ‘চিফ আং’ বা রাজা, বছর ষাটেকের ন’গো আং-এর মুখে উল্কির ছাপ অস্পষ্ট হয়ে গেলেও তাঁর গলায় ঝোলা পিতলের পাঁচটি মাথা সেই শৌর্যেরই নিদর্শন। তাঁর বৃদ্ধ দেহরক্ষীর মাথায় পালকের মুকুট। হাতে, লম্বা বাঁশের মাথায় দায়ের ফলা। দশটি মাথা কাটার রক্তাক্ত ইতিহাস জড়িয়ে আছে সেই ফলায়।
লংগোয়া গ্রামের সব থেকে বড় কাঠ আর বাঁশের বাড়িটাই রাজার বাড়ি। |
|
মেজাজটাই তো আসল রাজা। —নিজস্ব চিত্র |
সেই বাড়ির অর্ধেক ভারতের মাটিতে, বাকিটা মায়ানমারে। সীমান্তের কাঁটাতার সশ্রদ্ধভাবে রাজবাড়ির এলাকা এড়িয়ে গিয়েছে। প্রায় পাঁচ হাজার ফুট উচ্চতায় স্থাপিত এই রাজবাড়িতেই একমাত্র টিউবলাইট আর টিভির দেখা মেলে। টিভিটি অবশ্য চলে না। সেটি শুধু রাজকীয় বৈভবের প্রতীক। কয়েকটি গ্রাম মিলিয়ে আছে একটিমাত্র ইনভার্টার। তা থেকে চার্জ হয় রাজা ও কয়েকজন ভাগ্যবান প্রজার মোবাইল ফোন। টাওয়ার ধরতে গেলে অবশ্য টিলায় চড়তে হয়।
নাগাল্যান্ড সদ্য মিটল নির্বাচন। রাজার আক্ষেপ, তাঁর বেশির ভাগ প্রজা ইচ্ছা থাকলেও ভোট দিতে পারেননি। কারণ, তাঁর রাজত্বের মধ্যে পড়া ৫২টি গ্রাম মায়ানমারের ভিতরে। ভারতের দিকে তাঁর প্রজা মাত্র চারটি গ্রামে ছড়িয়ে আছে। তাই, ২৩ ফেব্রুয়ারি মাত্র চারটি গ্রামের প্রজাকেই তিনি ভোট দিতে পাঠান। কাঠের ঘরে বাঁশের পাইপে আফিম টেনে চলেন রাজা আং। পারিষদেরা বলেন, “সব প্রজারা ভারতের মাটিতে ভোট দিতে পারলেরাজামশায় কবেই বিধায়ক হয়ে যেতেন।”
রাজা আং তাই বিধায়ক হতে পারেননি। তাঁর সংসার চলে প্রজাদের দেওয়া আফিম, চাল, সব্জি, মাংস দিয়ে। রাজদর্শনের নজরানা বলতে কাঠ ও ধাতুর খোদাই করা গয়না। ফোমচিং কেন্দ্রের অধীনে পড়ে ন’গো আং-এর রাজত্ব। গত পাঁচ দফায় সেখানে টানা জিতেছেন কে কংগাম কন্যাক। এ বারেও সম্ভবত তিনিই জিতবেন। কারণ, কন্যাকরা পরিবর্তন নয়, গতানুগতিকতায় বিশ্বাসী। ব্রিটিশরা, দুর্দম কন্যাকদের ঠান্ডা করতে আফিমের নেশা ধরিয়েছিল। সেই আফিম এখনও মুণ্ড-শিকারিদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তাই সাত স্ত্রী ও বিশ সন্তানের জনক কন্যাক নৃপতি খেয়ালই রাখেন না, কে নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী, কেই বা সাংসদ, কেই বা বিধায়ক? তিনি কেবল জানেন, তাঁর পরে, বড় বউয়ের বড় ছেলেই এই রাজ্যপাটের মালিক হবে। সেই নির্বাচনে, তিনিই শেষ কথা। যত দিন বাঁচবেন, এ মেজাজ নিয়েই থাকবেন। |
|
|
|
|
|