অবৈধ কয়লার কারবার বন্ধ করে নজির সৃষ্টি করেছে রাজ্য সরকার, এমনটাই দাবি করেছেন রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী মলয় ঘটক। আর তাঁর এই মন্তব্য নিয়ে চাপানউতোর শুরু হয়েছে শিল্পাঞ্চলের রাজনৈতিক মহলে। নানা রাজনৈতিক নেতার দাবি, মন্ত্রী এমন দাবি করলেও বাস্তব সম্পূর্ণ আলাদা।
রবিবার জেকে নগরে আইএনটিটিইউসি অনুমোদিত কেকেএসসি-র পঞ্চম সম্মেলন ছিল। সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। মলয়বাবু সভাপতি এবং হরেরাম সিংহ সাধারণ সম্পাদক পদে পুনর্নিবাচিত হন। ৬৫ জনের নতুন কমিটিতে সম্পাদক থেকে সহ-সভাপতি হলেন নরেন চক্রবর্তী। উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের পাশাপাশি প্রভাত চট্টোপাধ্যায়কে যুগ্ম কার্যকরী সভাপতি করা হয়। সম্মেলনে মলয়বাবু বলেন, “রাজ্য সরকার অবৈধ কয়লা কারবার বন্ধ করেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেট গঠন করায় কার্যত খনিকর্মীদেরই বেশি লাভ হয়েছে।” আইএনটিটিইউসি-র রাজ্য সভানেত্রী দোলা সেন বলেন, “মাফিয়ারাজ বন্ধ করা হবে। কোনও ভাবেই কয়লা চোরদের দৌরাত্ম্য মানা যাবে না।” |
নিত্যচিত্র।—নিজস্ব চিত্র। |
কৃষিমন্ত্রীর কয়লা পাচার বন্ধের দাবি নিয়েই সরব হয়েছেন বিরোধীরা। সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য তুফান মণ্ডলের দাবি, অন্ডালে কাজোড়া রেললাইনের পাড়ে কোড়াপাড়া, শিকারপুকুর, শ্মশানঘাট এবং গোলাইয়ে মালগাড়ি দাঁড় করিয়ে কয়লা নামাচ্ছে চোরেরা। সকাল ৬টা থেকে কী ভাবে স্কুটারে করে কয়লা পাচার হচ্ছে, তা দেখতে পাচ্ছেন বাসিন্দারা। এর সঙ্গে পরাশকোল এবং সিদুলিতে সাইকেল, পিক-আপ ভ্যানে কয়লা পাচার হচ্ছে। এই সব কয়লা কোলিয়ারি থেকে চুরি হচ্ছে বলেই দাবি তাঁর।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বারাবনির মাজিয়ারা এবং লাগোয়া সাঁওতালপাড়ায় বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ নিয়ে অবৈধ খননের জন্য পাম্প চলছে। বারাবনি গ্রাম, কবিরবাঁধ, কাটাপাহাড়িতে রমরমিয়ে খনন হচ্ছে। জামুড়িয়ায় সরিষাতলি এবং চুরুলিয়ার দু’টি বেসরকারি খনি থেকে কয়লা রীতিমতো লুঠ হচ্ছে। কেলেজোড়া, বীরকুলটি, সত্তর হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়। জামুড়িয়ার মিছিরডাঙা, শিবপুর, সুপারিতলা এবং হুরমাডাঙায় অবৈধ খনন চলছে। পরাশিয়া, কেন্দা এবং নর্থ সিহারশোল খোলামুখ খনি থেকে কয়লা চুরি করছে দুষ্কৃতীরা। সাতগ্রাম ফটকের অবৈধ ডিপোয় শ্রীপুর এবং সাতগ্রাম দুই এরিয়ারই কয়লা আসছে। সাতগ্রাম সেন্ট্রাল ডিপোর গেট থেকে ছ’দিন আগে চোরেরা কয়লা নিয়ে পালাচ্ছিল। অভিযোগ, এক নিরাপত্তারক্ষীও তাতে জড়িত ছিলেন। রানিগঞ্জের নিমচার ডিপোয় কয়লা আসছে দামালিয়া প্যাচ ও আমকোলা খনি থেকে। মহাবীর কোলিয়ারি, কুমোরবাজারে গ্যাস গোডাউনের কাছে এবং রানিগঞ্জ থানার অদূরে কলেজ পাড়ার পিছনে বড়দহির কাছে অবৈধ কয়লা মজুত ও পাচার হচ্ছে।
আসানসোলের কল্যাণপুর ঢোকার মুখে নুনিয়া ব্রিজের ডান পাড়ে সকাল ৬টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত এবং কল্যাণপুরে পুলিশ ক্যাম্পের কাছে রাস্তার ধারে ভোর ৪টে থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত রীতিমতো কয়লা কেনাবেচার অস্থায়ী হাট বসে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। সকাল ৫টা থেকে ৮টার মধ্যে আসানসোলের রেল স্টেডিয়ামের রাস্তা ধরে পুরনো জি টি রোড পেরিয়ে প্রচুর কয়লা বোঝাই সাইকেলকে বার্নপুরের দিকে যেতে দেখা যায় বলে বাসিন্দারা জানান।
সিপিএমের অজয় জোনাল কমিটির সম্পাদক মনোজ দত্তের অভিযোগ, “মাঝে কয়লা চুরি অনেকটাই কমেছিল বটে। কিন্তু এখন আবার চোরেদের বাড়বাড়ন্ত দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে পঞ্চায়েত ভোটে সাফল্যের জন্য শাসকদল কয়লাচুরির ক্ষেত্র করতে চাইছে। যে কোনও নিরপেক্ষ তদন্তেই তা প্রমাণ হয়ে যাবে।” কংগ্রেসের জেলা (শিল্পাঞ্চল) কমিটির সাধারণ সম্পাদক তরুণ গঙ্গোপাধ্যায়ের দাবি, “সিপিএমের পথেই হাঁটছে তৃণমূল। শিল্পাঞ্চলে অবৈধ কয়লার কারবার পুরোপুরি বন্ধ কোনও দিনই হয়নি। এখন আবার সেই পুরনো অবস্থাতেই ফিরে এসেছে।” মলয়বাবুর মতোই তৃণমূলের জেলা (শিল্পাঞ্চল) সম্পাদক ভি শিবদাসনেরও বক্তব্য, “সিপিএম কয়লা চুরিকে হাতিয়ার করে খনি অঞ্চলে একের পর এক ভোট বৈতরণি পার হয়েছে। এখন ওরা মনে করছে, তৃণমূলও তা করবে। আসলে কিন্তু কয়লা চুরি পুরোপুরি বন্ধ।”
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইসিএলের এক আধিকারিক দাবি করেন, মাঝে অবৈধ কয়লা কারবার প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবে বেশ কিছু দিন সালানপুর, শ্রীপুর এবং পারবেলিয়ায় অবৈধ খনন বাড়ছে। ইসিএলের সিএমডি-র কারিগরি সচিব নীলাদ্রি রায় আবার বলেন, “কয়লা চুরি কিছুটা তো কমেছিল বটেই। এ বার আমাদের ই-অকশনে কয়লা বিক্রিও বেড়েছে।” পুলিশ কমিশনার অজয় নন্দ বলেন, “প্রচুর অভিযান চালিয়ে বহু কয়লা চোরকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিযোগ পেলেই পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে।’’ |