দুপুরে চিপকের ভিডিও স্ক্রিনে নানান ক্রিকেটীয় কুইজ আর তার তলায় সফল উত্তরদাতাদের নাম ভেসে উঠছিল। হঠাৎ দেখা গেল নতুন প্রশ্ন ভেসে উঠেছে ক্রিকেটকে ব্যাখ্যা করুন! ডিফাইন ক্রিকেট!
এটা আবার কেমন বিটকেল প্রশ্ন! এর তো বর্ণনাভিত্তিক জবাব হবে। সেটাও এক-এক জন এক-এক রকম ভাবে বলবে। কুইজ কী করে হল বাবা?
হঠাৎ দেখা গেল চিপক জয়ী উত্তরদাতার নাম দেখিয়ে দিচ্ছে। ‘অ’ দিয়ে নামটা শুরু। অরুণ বা এ রকম কিছু। ক্রিকেটকে ব্যাখ্যা করুন-এর উত্তর যিনি খুব সংক্ষেপে দিয়েছেন।
সচিন তেন্ডুলকর!
রূপকথার মতো লাগছিল। আর কখনও ভারতীয় ক্রিকেট মাঠ— প্রবাদ এবং বাস্তব এ ভাবে একই ফ্রেমে মিলিয়ে দেখার অবিশ্বাস্য সুযোগ পাবে তো! ক্রিজে যে তখন স্বয়ং সচিন তেন্ডুলকর! বটগাছের মতো ইনিংসকে ছায়া দিতে শুরু করেছেন অসি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে।
রাতে সাদা কভারে ঢেকে দেওয়া চিপকের বুকের কাছাকাছি হাঁটতে হাঁটতে দিশা খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করছি, রবিবাসরীয় সকালটায় জাতীয় সুখের মন্তাজ কি অপেক্ষা করে থাকবে? চাই তো মাত্র ২৯ রান। কিন্তু হবে? তৃতীয় দিনের টিকিটের চাহিদা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। |
মনে হচ্ছে সকাল থেকে দৈনিক টিকিটের জন্যে লাইন পড়বে। চিদম্বরম স্টেডিয়ামে একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখছি। গ্যালারি বেশ কিছুটা ফাঁকা অথচ এ দিন দৈনিক টিকিট না পেয়ে অনেকে ফিরে গেলেন। তামিলনাড়ু ক্রিকেটসংস্থার কর্তা জানালেন, চোদ্দো হাজার টিকিট রাজ্য সরকারকে দিতে হয়। অথচ সরকারি কর্মচারী অর্ধেকই আসেন না। রোববার আবার মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার জন্মদিন। অনুগত সরকারি অফিসাররা কি বোয়েস গার্ডেনে জয়ললিতার বাড়ির সামনে ভিড় করবেন? না কি ক্রিকেট স্টেডিয়ামে চলে আসবেন সচিনের টানে। টেস্ট ক্রিকেট ঘিরে চরম এই অনাগ্রহের যুগেও শনিবার সকাল থেকে তিনি হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো লোক টানছেন।
তেন্ডুলকরকে ঘিরে ইদানীং কালের শঙ্কা, সন্দেহ আর রাজনীতির বাতাবরণে এমনটা যে ঘটবে কে ভেবেছিল! মরসুমের শুরুতে যে তেন্ডুলকর নিউজিল্যান্ডের মাঝারি গতির সিমারের বিপক্ষে পা নিয়ে যেতে পারছিলেন না। তিনি ঘণ্টায় দেড়শো কিলোমিটার গতিতে আছড়ে পড়া জেমস প্যাটিনসনকে খেললেন যেন কোনও রঞ্জি বোলার খেলছেন। অচঞ্চল ফুটওয়ার্ক। অনেক সময় নিয়ে প্রশান্তির সঙ্গে মিড ব্যাটে ঢা-ক-ক। ঢা-ক-ক। তা-ও ক্ল্যাসিক্যাল ব্যাটসম্যানশিপের আইনানুগ। পুরো ব্যাটটা দেখিয়ে। মাত্র দু’টো ডেলিভারি যে আস্ত একটা টেস্ট ম্যাচের মাস্তুল ঘুরিয়ে দিতে পারে গত গাওস্কর-বর্ডার ট্রফি মোক্ষম দেখেছে। এম সি জি-তে অস্ট্রেলিয়ার তিনশো কিছু তাড়া করে ভারত ২১৪-২। রাহুল-সচিন পার্টনারশিপে দু’জনেরই হাফসেঞ্চুরি হয়ে গিয়েছে। ওপরে চলে যাওয়া সি কে নাইডু-রাজ সিংহ-রা সমেত গোটা ভারতীয় ক্রিকেটকুল নিশ্চিন্ত। ঠিক সেই অবস্থায় তৃতীয় দিন সকালে পিটার সিডলের সিম করা ভেতরে আসা বলে অকস্মাৎ বোল্ড হয়ে গেলেন সচিন। পরের ওভারেই হিলফেনহসের অবিকল ডেলিভারিতে বোল্ড দ্রাবিড়। হুড়মুড়িয়ে ভারত অল আউট হয়ে গেল ২৮২। টেস্ট হারল। তার পর সিরিজও কিনা গচ্চা দিল ০-৪।
জেমস প্যাটিনসন এম সি জি মাথায় আছে বলেই বোধহয় এত আস্থার সঙ্গে দেশীয় রিপোর্টারদের বলছিলেন, “লাগবে তো দুটো বল। সচিন আর কোহলি!” ভারত সমর্থকদের কেবল মনে হতে পারে, বল দুটো কি রোববার সকালে হবে? না শনিবার দুপুরেই হয়ে গিয়েছে?
ধোনির ভারত তখন ১২-২। প্রেসবক্সে এক জন চেঁচিয়ে বললেন, “গেল! সেভেনটি এইট অল আউট।” সচিন নামছেন। যথারীতি হাততালির পুষ্পবৃষ্টির মধ্যে। নামলে কী হবে। চশমা পরে নামা সহবাগ যে ভাবে প্লেড অন হলেন। তার আগে মুরলী বিজয় যে ভাবে এক্সপ্রেস গতির সামনে ব্যাটই নামাতে পারলেন না তাতে ড্রেসিংরুমে একটাই সঙ্কেত যায় ভাইসব পালাও এবং বাঁচো। এই গতির সামনে যে পালাতে পারবে সে-ই না পরের দিন জীবিত থাকবে! |
তেইশ বছরের প্যাটিনসনকে তখন মত্ত ষাঁড় মনে হচ্ছে। প্রথম বলটাই ভেতরে আসা। সচিন যে ডেলিভারিতে ইদানীং বারবার আউট হচ্ছেন। পা গিয়ে পৌঁছচ্ছে না। আজ সেটাই বাঁ পা সামনে রেখে হালকা পুশ করলেন। কভার দিয়ে চার। পরের বলটা স্টিয়ার করে দিলেন থার্ড ম্যান আর পয়েন্টের মধ্যিখান দিয়ে। স্ট্রোক দুটো দেখে কে বলবে, যে বয়স্ক লোকটা ফাস্ট বোলারের খুনে আগ্নেয়াস্ত্র সামলাচ্ছে, তাঁর প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি তেইশ বছর আগে। হ্যাঁ, যে বছরে এই ফাস্ট বোলারটা জন্মেছিল!
মেলবোর্নের একটা দিনের শুরু যদি সিরিজের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। চেন্নাইয়ের মাঝদুপুরই বা ঘুরিয়ে দিতে আপত্তি কীসের। প্যাটিনসনের ওই ওভারের শেষ বলে অন-এ আর একটা বাউন্ডারি। দ্রুতই যেন মনোবিদের ওষুধ খেয়ে ডিপ্রেশন থেকে গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়াল ভারত। পূজারা সাহস পেলেন। বিরাট কোহলিকেও বিকেলে মনে হল পালটা চাপ তৈরি করতে পারছেন অতিথিদের ওপর। হাত খুলে ড্রাইভ মারছেন। ভয়ে বগল চেপে যাচ্ছে না।
তখন অস্ট্রেলিয়া? হু-ম-ম। জন বুকানন সম্পর্কে আধুনিক অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটার যতই অশ্রদ্ধা প্রকাশ করুক, ভারত সফরে এখনও সেই বুকানন মডেলই তারা ধরে রয়েছে। বোলার একটু মার খেলেই আর সর্বাত্মক অভিযান নয়। বোলিং নীতি হয় রান চোক করো। চার আটকাও। অভিজ্ঞতা বলছে, বাউন্ডারি পেয়ে গেলেই ভারতীয়রা রানের ঝরনার যেন উৎসমুখ পেয়ে যায়। তাই এত মজবুত অবস্থা থেকেও দ্রুত পেসারের জন্য স্লিপ সরিয়ে নিলেন ক্লার্ক। সুইপার কভার চলে এল। তাঁর টিম কিনা আড়াইশো রানে এগিয়ে থাকা অবস্থায়। বোঝাই যাচ্ছে প্যাটিনসনের গতি সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার চাবিকাঠি। চোট থেকে ফিরে আসা ফাস্ট বোলারকে তাই ‘শক’ বোলার হিসেবে ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন ক্লার্ক। ডিন জোন্স যতই টুইট করুন এটা কী হচ্ছে, প্যাটি মাত্র ছ’ওভার কেন গোটা দিনে? তিনি ক্লার্ক জানেন, কেন! বোলারেরও কোনও অভিমান নেই। জানেন ক্যাপ্টেনকে শুধু তো চিপকে নয়। কোটলার শেষ টেস্টেও তাঁকে সুস্থ রাখার কথা ভাবতে হচ্ছে!
বিশ্বাসের এই সম্পর্ক অবশ্যই ধোনি-হরভজনে অটুট নেই। সকালে ভাজ্জি একমাত্র উইকেটটা পাওয়া মাত্র ধোনি দৌড়ে এলেন তাঁর অভিনন্দন জানাতে। বোলার না তাকিয়ে পাশ দিয়ে চলে গেলেন। কেউ যদি ‘ফ্রিজ’ করে ছবিটা দেখায়, সম্পর্কের শৈত্য বোঝাতে আর একটা অক্ষরেরও প্রয়োজন নেই। শততম টেস্টের প্রথম দিন সর্দার নিরাশ করেছেন খুব সত্যি কথা। কিন্তু আফটার অল তিনি চারশোর বেশি উইকেট নেওয়া একজন বোলার যাঁকে অস্ট্রেলিয়া ডরায়। এটা কী ধরনের ক্যাপ্টেন্সি যে দ্বিতীয় প্রধান বোলার কাল ৬১ তম ওভারে শেষ বল করেছিল। আজ বল পেল অস্ট্রেলীয় ইনিংসের ১১২ তম ওভারে। যে কেউ বলবে এ তো সিনিয়রকে চরম অপমান এবং অনাস্থা। মজার কথা, টিভি ভাষ্যকারদের কারও মুখে শোনা যায়নি। বিসিসিআই টিভিতে কমেন্টেটর হিসেবে ভাসমান থাকার শর্ত অ্যাদ্দিনে ক্যামেরাম্যানরাও জেনে গিয়েছে একটা পর্যায়ের পর ধোনির সমালোচনা করা যাবে না।
ভিভিএস লক্ষ্মণ নতুন এসেছেন। সম্ভবত ভাষ্যকার হিসেবে দীর্ঘকালীন ভাবে টিকে থাকার কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষাও নেই। সকালে তিনি ধোনির বেসরকারি বাস্তুভিটেয় শোরগোল ফেলে দিলেন এই বলে যে ভাজ্জিকে ওর ক্যাপ্টেন প্রকাশ্যে বুঝিয়ে দিচ্ছে তুমি টিমে অবাঞ্ছিত। আর ধোনির নেতৃত্বের স্টাইলটাই এ রকম, কোনও দিন ফর্মে না থাকা প্লেয়ারকে সাহস জোগায় না।
টুইটার এবং ফেসবুকে হায়দরাবাদির গাঙ্গুলিসদৃশ এমন বেপরোয়া মন্তব্য ছড়িয়ে যাওয়ার পর চেন্নাইস্থিত ভারতীয় ক্রিকেটমহলে বিস্ফোরণের বাতাবরণ তৈরি হল। মিডিয়াও বিস্ফারিত। কী চাইছে? একটা টেস্ট কমেন্ট্রি করেই ছেড়ে দিতে? জনমত হল, মরাঠির বাকি ২৯ রান ঘটে ১০১তম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি হবে কি না তা নিয়ে যেমন অনিশ্চয়তা আছে। তার চেয়েও বেশি অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে ভিভিএস-এর মাইক্রোফোন হাতে জীবন।
দিন শেষে শেন ওয়ার্ন আর লক্ষ্মণ নামছেন। ভক্ত জিজ্ঞেস করলেন ওয়ার্নকে। “কাল ঘটছে তো?” ওয়ার্ন বললেন, “জরুরি নয়। জরুরি হল সেই প্রাচীন কথাটা। আজ সচিনকে দেখে যা মনে পড়ে গেল। ফর্ম ক্ষণস্থায়ী, জাত চিরকালীন। ফর্ম ইজ টেম্পোরারি, ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট।”
ওয়ার্নের চেহারাটা এ বার যেন আরও বদলেছে। দাঁতের সেটিংটাও কি বদলেছেন? প্রেস বক্সে তাঁর অনুরাগিণীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ: লিজ হার্লি এসে কেমন একটা কদাকার করে দিচ্ছে ওয়ার্নকে। বোটক্স টোটক্স কী সব করাচ্ছে। এ বার দাঁতটাও বদলে দিয়েছে।
সচিনের প্রতি পেশাদারি শ্রদ্ধা অবশ্য দেখা গেল লিজ হার্লি জমানাতেও অক্ষত। এই চিপকেই তো সচিন-ওয়ার্ন সম্মানযুদ্ধের শুরু। যুগ আসে। যুগ যায়। জিনিয়াস থাকে। যদি বা মাঝেমধ্যে তাঁকে ২৯ রানের জন্যও পরীক্ষায় নামতে হয়।
|
অস্ট্রেলিয়া
প্রথম ইনিংস (আগের দিন ৩১৬-৭) |
ক্লার্ক ক ভুবনেশ্বর বো জাডেজা ১৩০
সিডল ক সহবাগ বো হরভজন ১৯
প্যাটিনসন নঃআঃ ১৫
লিয়ঁ ক কোহলি বো অশ্বিন ৩
অতিরিক্ত ৮
মোট ৩৮০ অল আউট (১৩৩ ওভারে)।
পতন: ৬৪, ৭২, ১২৬, ১৩১, ১৫৩, ৩০৪, ৩০৭, ৩৬১, ৩৬৪, ৩৮০।
বোলিং: ভুবনেশ্বর ১৩-১-৫২-০, ইশান্ত ১৭-৩-৫৯-০, হরভজন ২৫-২-৮৭-১,
অশ্বিন ৪২-১২-১০৩-৭, জাডেজা ৩৬-১০-৭১-২।
|
ভারত
প্রথম ইনিংস (১৮২-৩) |
মূরলী বো প্যাটিনসন ১০
সহবাগ বো প্যাটিনসন ২
পূজারা বো প্যাটিনসন ৪৪
সচিন নঃআঃ ৭১
কোহলি নঃআঃ ৫০
অতিরিক্ত ৫
মোট ১৮২-৩ (৫২ ওভারে)।
পতন: ১১, ১২, ১০৫।
বোলিং: স্টার্ক ১৪-২-৩৭-০, প্যাটিনসন ৬-১-২৫-৩, সিডল ৮-১-৩১-০,
লিয়ঁ ১৪-০-৫৫-০,
হেনরিকে ৮-২-১৭-০, ক্লার্ক ২-০-১৪-০। |
|
|