|
|
|
|
|
|
ব্যাগ গুছিয়ে...
|
ডাকছে বড়ন্তি
শীতভোরে বড়ন্তি ছবি হয়ে থাকে। আকাশচেরা রঙিন সূর্যালোকে কাঁচা পথের
দু’ধারে সবুজে সারা রাত জমে থাকা শিশিরবিন্দুগুলো যেন মুক্তো
হয়ে যায়,
রঙিন মুক্তো। ঘুরে এলেন
শৈবাল দাস |
|
পায়ে ছুট থাকলে বেরিয়ে পড়াটা যে কোনও ব্যাপার নয়, মুরাডি স্টেশনে নামতে নামতে সেটা মনে হচ্ছিল। ঠান্ডাটা জাঁকিয়ে পড়েছে, আকাশ ঝলমলে ফরসা। জঙ্গলমহলের বারুদের গন্ধ যেন উত্তরের তীব্র হাওয়ায় কোথায় মিলিয়ে গেছে। পুরুলিয়ার গ্রাম-পাহাড় জুড়ে শীত, পরবের তীব্র হাতছানি।
আপাদমস্তক শীতপোশাকে ঢাকা অবস্থায় স্টেশনের বাইরে গরম চায়ের গ্লাসে শরীর জুড়ে অনন্য অনুভূতি। এই মুহূর্তে গ্রামের সবুজ ফসলে হাটের বিকিকিনি শুরু হয়ে গেছে। ঝটপট মনের আয়েসে সব্জি টানাটানি। সওদায় ভীষণ ফায়দা এখানে। রিসর্টের গাড়ি আসার আগেই আমাদের বাজারের ব্যাগ গোছানো শেষ। সূর্যের সতেজ আলোয় চারপাশে তখন সবুজ বনজে জোগাচ্ছে
যৌবনের ক্লোরোফিল।
পথে যেতে যেতেই প্রায় চোখে পড়ছে ঝিলিক দেওয়া রঙিন হৃষ্টপুষ্ট মোরগ নিয়ে আদিবাসীরা হেঁটে, সাইকেলে চলেছে কোথায়। একজন তো মোরগের পায়ে কাতান (ছোট ছুরি) বাঁধছে এক মনে। ‘ব্যাপার কী গো?’ ট্যুরিস্টের অবাক প্রশ্নে ফিক করে হেসে ফেলে আদিবাসী বুঢ়া। আধখানা দাঁতে মিচকি হাসি। ‘ওন ডা ম্যাচ আছে রে বাপ, মোকুড়া শালনি মাঠে।’ ‘কী খেলা গো।’ মোরগটা মাথায় তুলে দেখায়, ‘মোরগ লড়াই রে বাবু, আসবি কেনে।’ মন নেচে ওঠে অপূর্ব নিমন্ত্রণে।
|
|
স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছেড়ে গাড়ি যখন কাঁচা মোরাম পথে পড়ল তখন বড়ন্তি পাহাড় টিলা আর রামচন্দ্রপুর ড্যাম একসঙ্গে আমাদের সঙ্গী হল। গাড়ির চাকায় তখন ঝুপঝাপ পাতার ঝাঁপ আর বি-ইটারের ট্যুইটি ট্যুইটি শিসে শুনি ‘স্বাগতম’ ধ্বনি। ড্যামের পাড় ঘেঁষে রিসর্টে গাড়ি থামল এসে। বুকে তখন তাজা অক্সিজেন। বাংলো ঘিরে সেগুন, শিশু, দেবদারু, মেহগনির লম্বা সুঠাম দেহবল্লরির সঙ্গে, কেয়ারি রঙিন ফুলের বাহারি চটকের চুপি চুপি ইশারা। রিসর্টের নিরালা অবস্থান আর সৌন্দর্য দেখে মন বলে উঠল, ‘ইস! বাঙালি যে কেন এত দূরে খরচা করে হনিমুনে যায়?’
জীবনদার জীবন ফিরে পাওয়া সুস্বাদু ভোজনের পরে, চল বেড়িয়ে আসি আদিবাসী গ্রাম ছাড়িয়ে, বনপথ ধরে সেই ‘শালনির’ মাঠে, যেখানে জমে উঠেছে জীবন-মরণের মোরগ-লড়াই। কাতানের কোপে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মোরগ হারলেই সে চলে যাবে বিজয়ী মোরগের মালিকের হাতে, এটাই নিয়ম। তা ছাড়া, বিজয়ী মোরগ-মালিক পেতে পারে টাকা, মদ, জামা। সে এক জমাটি অভিজ্ঞতা।
বাইরের অতিথি আমরা। নির্বিষ আদিবাসীদের পরম যত্নে বানানো টাটকা হাঁড়িয়া উৎসবে হাজির হয়ে ওদের উপহার পাওয়া মোরগ নিয়ে যখন টলমল ফিরে আসা, তখন ত্রয়োদশীর চাঁদ কবির লেখা চুরি করে গাইছে, ‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে...’।
অনিয়মিত কমজোরি বিদ্যুৎকে ছুটি দিয়ে চাঁদের আলোয় যখন খোলা ক্যাম্পাসে চলছে মুনলাইট ডিনার, তখন জলাধারের পাখিরা আর কুম্ভাটুয়ার কুব-কুব শব্দে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে মন ভিজে যাচ্ছিল বারবার।
শীতভোরে বড়ন্তি ছবি হয়ে থাকে। ধামসাই আকাশচেরা রঙিন সূর্যালোকে কাঁচা পথের দু’ধারে সবুজে সারা রাতে জমে থাকা শিশির বিন্দুগুলো যেন মুক্তো হয়ে যায়, রঙিন মুক্তো। যায় বলেই বারেবারে দেখতে ইচ্ছে করে। ভরা বর্ষায় প্রকৃতি এখানে আবার অন্য ভাবে বদলায়। শীতদুপুরে বড়ন্তি জলাধারের পাড়ে তেল সপ্সপ্ পিঠে সানবাথ, হলফ করে বলছি, লা জবাব। কোনও নদীর সৃষ্টি নয় এই জলাধার। পাহাড় ধোয়া জলে প্রাকৃতিক সৃষ্টি।
|
|
‘ড্যামের জলে মাছের চাষ, আর চাষের জল আমাদের একমাত্র ভরসা’, মাছশিকারি আদিবাসীটি বলতে বলতে জলে জাল ঝপাং। জালে তখন মিষ্টি মৃগেলের ছটফট। এক আছাড়ে কাতলার কাতরানি থামিয়ে তখন তার মুখে যুদ্ধ জয়ের চওড়া হাসি। প্রাকৃতিক সুইমিং পুলে জল ছেটানো খেলা শেষ। এ বার পেটভর্তি করে, গাড়ি নিয়ে মোরাম পথ পেরিয়ে, গ্রাম ছাড়িয়ে গন্তব্য জয়চণ্ডী পাহাড়।
রঘুনাথপুর শহরের কাছে, আদ্রা স্টেশন থেকে ৫ কিমি, আর আদ্রা-আসানসোল লাইনে জয়চণ্ডীর নিজস্ব স্টেশন থেকে পাহাড়টাকে ছোঁয়া যায়। সোনারোদে মাখামাখি পাহাড়ি পথের নীচে তখন দেদার ছুটির মজা। এই অপূর্ব জায়গাটা কেন সত্যজিৎবাবু ‘হীরক রাজার দেশে’র জন্য বেছেছিলেন তা এই দেশে পা না রাখলে কি বোঝা যেত? পাথুরে রুক্ষ সৌন্দর্যের উপর রোদের আলোয় সত্যিই ‘হীরকোজ্জ্বল’ এই অঞ্চল।
খাড়াই পাহাড় ধরে তখন শিক্ষানবিশদের ট্রেনিং পাঠ চলছে। আমাদের লক্ষ্য জংলি, পাহাড়ি ঢালু পথ বেয়ে একদম উপরে জয়চণ্ডীমাতার আশীর্বাদ নেওয়া। শ’পাঁচেক মিটার পথ বেয়ে যখন পথ চলা শুরু হল তখন হি-হি করা ঠান্ডা ক্রমশ উষ্ণতায় ঢেকে যাচ্ছে। পথ চলতে আলাপ হল মন্দিরের পুরোহিতের সঙ্গে। কয়েক পুরুষের পেশা। পথ মাঝে দেখালেন পুরনো মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। এখান থেকেই উদয়ন পণ্ডিত মশাল দিয়ে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন গুপি-বাঘাকে আর তারপর...সে গল্প জানে সব্বাই। ইতিহাসকে ছাপিয়ে এক নতুন ইতিহাসের সৃষ্টি হল এখানে। জয়চণ্ডী পাহাড়ের মাথায় নতুন ঝাঁ-চকচকে মন্দির তখন ভক্তের সমাগমে জমজমাট। এই পাথুরে এলাকায় সবচেয়ে উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে চার দিকে পাখির চোখে দেখে নেওয়া যায় দূরে বহু নীচে সন্নিহিত গ্রাম জয়চণ্ডী, বেরো রামকানালির পটভূমি। আবাদি জমির আদিগন্ত চাষের মাঠের মাঝখানে লুকোনো রেলপথটা জেগে ওঠে হঠাৎ। ডিজেল ধোঁয়া ওড়ানো প্যাসেঞ্জার ট্রেনের ভোঁ...শব্দটা তখন ভীষণ ভীষণ ভাল লাগে। |
ছবি: রত্নাঙ্ক ভট্টাচার্য |
কী ভাবে যাবেন |
আদ্রা থেকে মুরাডি স্টেশন বা আসানসোল থেকে মুরাডিগামী ট্রেনে। |
কখন যাবেন |
দুটি বাংলো ছয়টি ঘর-সহ থাকার জায়গা আছে বড়ন্তি জলাধারের পাশে। |
কোথায় থাকবেন |
প্রচণ্ড গরম ছাড়া এখানে প্রকৃতি অবারিত সব সময়। |
|
|
|
|
|
|
|