|
|
|
|
ভোটে মেঘালয় |
শিলঙে মাটি হারানো বাঙালির লড়াই |
রাজীবাক্ষ রক্ষিত • শিলং |
শীতের শেষ বেলায় ঠাণ্ডায় জবুথবু শিলং। ঠিক তখনই পাড়ার মোড়ের জনসভা কাঁপাতে হাজির ছিলেন রাজ বব্বর। কিন্তু ঠান্ডার কাঁপুনিতে সভা জমেনি তেমন। ৪২ বছরের পাহাড়ি রাজ্যে গত পাঁচ বছরে, দু’টি জোট, চার মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে চার বার সরকার গড়েছে। কিছুটা সময় জারি ছিল রাষ্ট্রপতি শাসনও। এমন ‘অস্থিরমতি’ এক রাজ্যের রাজধানী শিলং-এর তো নির্বাচনের আগে ফোঁসার কথা। কিন্তু ইতস্তত মোড়ের মাথার জনসভা ভিন্ন শিলঙে ভোটযুদ্ধের কোনও মহড়াই চোখে পড়ে না। সাংমাদের রাজত্বে রাজ্য-রাজনীতিতে শিলঙের গুরুত্ব কমেছে। তবু রাজধানী রাজধানীই। এখানকার রাজনৈতিক সমীকরণের অনেকটাই নির্ভর করে রয়েছে বাঙালির হাতে।
‘নন-ট্রাইবাল’ বা ‘দখার’দের সবচেয়ে বড় প্রতিনিধি শিলঙের বাঙালির সেই দাদাগিরি বর্তমানে একেবারেই অস্তাচলে। পুরনো বাঙালি ক্রম হ্রাসমান। যাঁরা রয়েছেন, তাঁরাও রাজ্য-রাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ। তবুও খাসি পাহাড়ে
|
মানস চৌধুরী |
|
আবু তাহের মণ্ডল |
বাঙালি অস্তিত্বের বড় ভরসা মানস চৌধুরী। আর গারো পাহাড়ে বাঙালির লড়াইয়ে সেনাপতি হয়েছেন আবু তাহের মণ্ডল। হাওয়ায় ভাসছে, এতদিন পরে দুই বাঙালি একসঙ্গে রাজ্যের মন্ত্রী হতে পারেন। অবশ্য তার আগে অনেকগুলি ‘যদি’ আছে। কংগ্রেস, মানস ও আবু তাহের যদি একই সঙ্গে ভোটে জেতে তবেই সে সম্ভাবনা। সেই সঙ্গে দলের মধ্যে ‘লবি’-র লড়াইটাও মানস চৌধুরী বা আবু তাহের মণ্ডলের এখন পথের কাঁটা হতে পারে।
কোনও একটি দলের মৌরসীপাট্টা না থাকায় মেঘালয়ের ভোটে নির্দল প্রার্থীদের রমরমা অন্যান্য রাজ্যের চেয়েও অনেক বেশি। ওখানকার স্থানীয় বাঙালি সনৎ চক্রবর্তী আজ বলেন, “এখানে দল দেখে নয়, প্রার্থী দেখে মানুষ ভোট দেন। কাজ করে উপজাতিদের নিজস্ব সমীকরণ। তাই খামোকা আগে থেকে কোনও দলে নাম লিখিয়ে এখানে লাভ নেই। বরং ভোটের পরে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ তাদের সঙ্গে দর কষাকষি করলে লাভের পুরো ষোল আনা আশা।” সেই ধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই, এ বারের ভোটে মোট ৩৪৫ জন প্রার্থীর মধ্যে ১২২ জন নির্দল। লাবান, রিলবং সহ- দক্ষিণ শিলং কেন্দ্রটি এ বার পুনর্বিন্যাসের পরে তৈরি। একেবারেই বাঙালিপাড়া। সেখানে প্রধান লড়াই দুই বর্তমান বিধায়কের মধ্যে। আগে মাওপ্রেন থেকে দু’বার নির্দল হিসেবেই জিতেছেন মানস চৌধুরী।
ছিলেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী। আর এনসিপির সানবর সুলে লাবানের বর্তমান বিধায়ক।
১৯৭৮ সালের ১ এপ্রিল বাবার মৃত্যুর পরে শিলং টাইম্স পত্রিকার ভার হাতে তুলে নিয়েছিলেন মানসবাবু। পেয়েছেন পদ্মশ্রী। ২০০৮ সালে মন্ত্রী হওয়ার পরে পত্রিকার সম্পাদক পদ ছাড়েন। রাজ্যের পয়লা নম্বর সংবাদপত্রের মালিক হওয়াটা ভোটে তাঁকে জিততে সাহায্য করে, এমনটা মানতে নারাজ মানসবাবু। তাঁর মতে, তাঁর কাজ ও অনুপজাতিদের জন্য করা লড়াইটাকেই ভোট দেন মানুষ। বাস্তবিকই, মানসবাবুকে পছন্দ করেন না এমন বাঙালি অনেক। কিন্তু অসমিয়া ব্যবসায়ী বাবলু আহমেদের মতে, “এই এলাকায় আগে কেবল বাঙালি এবং অসমিয়ারাই ছিল। ধীরে ধীরে তাদের পায়ের নীচের জমি সরছে। রাজধানীতে দাঁড়িয়ে উপজাতিদের সঙ্গে সমানে টক্কর দিয়ে বাঙালি ও অনুপজাতিদের হয়ে লড়াই করার মতো শক্তিশালী নেতা কই? নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই বাঙালিরা এবারেও মানসবাবুকে ভোট দেবেন। দেবেন অসমিয়ারাও।” স্থানীয় রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ, মালবিকা বিশারদের মতে, “বাঙালি ঐক্যবদ্ধ না থাকার ফলেই আজকের সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দের স্মৃতিধন্য বাড়ি অবহেলায় পড়ে থাকছে। সে ক্ষেত্রে, একজন স্থানীয় বাঙালির বিধানসভায় সক্রিয় হওয়া অতি প্রয়োজন। তাহলে যদি বাঙালি তার প্রাপ্য মর্যাদা আদায় করতে পারে।” তবে কংগ্রেসই বলছে, লাবানের বর্তমান বিধায়ক এনসিপির সানবর সুলাইয়ের সঙ্গে যুদ্ধে মানসবাবুর জেতা তত সহজ হবে না। মানসবাবুর শিবিরের হিসাব, এখানকার ২১ হাজার ভোটের মধ্যে অন্তত ১১ হাজার ভোট মানসবাবুর বাঁধা।
অন্য দিকে, পশ্চিম গারো হিলে ফুলবাড়ির নির্দল প্রার্থী, ইঞ্জিনিয়ার আবু তাহের মণ্ডল মানসবাবুরও আগে রাজ্যের মন্ত্রী হয়েছেন। এখন রাজ্যের বিদ্যুৎ, পরিবহণ, আবগারি, জনসংযোগের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ সামলাচ্ছেন তিনি। বরাবর কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ আবু তাহের বলেন, “নির্দল থাকার বহু সমস্যা। তাই এ বার কংগ্রেসে যোগ দিলাম।” তাঁর ফুলবাড়ি কেন্দ্রে আগে বাঙালি ভোট ছিল ২০ হাজার। সীমানা বদলের পরে, তা কমে সাড়ে ১৩ হাজারে দাঁড়িয়েছে। মোট ভোটার ২২ হাজার। প্রতিপক্ষে সমাজবাদী পার্টির মণিরুল ইসলাম সরকার ছাড়াও রয়েছেন আরও হাফ ডজন বাঙালি প্রার্থী। তাঁর কথায়, “ভোট কাটবে ঠিকই। তবে আমায় বাঙালি বাদে অন্যরাও ভোট দেবেন। জনতা আমার কাজ, সততার উপরে আস্থা রাখে। সেটাই ভরসা।” |
|
|
|
|
|