সরকারের সিন্দুকে টাকা নেই। তাই ধনীরা আর একটু বেশি আয়কর দিক। প্রস্তাব ছিল এমনটাই। কিন্তু প্রবল আপত্তি তুলেছে শিল্পমহল। লগ্নিকারীরাও এতে বিমুখ হওয়ার আশঙ্কা। এই জোড়া চাপের মুখে ধনীদের জন্য আয়করের হার না বাড়িয়ে সারচার্জ বসানোর কথা ভাবছেন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম। সারচার্জ হল করের উপরে কর। অর্থাৎ যত টাকা আয়কর হবে, তার উপরে স্বল্প হারে অতিরিক্ত কর দিতে হবে। এতে কেন্দ্রের বিশেষ সুবিধার দিকও আছে, সারচার্জ বাবদ বাড়তি আয়ের ভাগ রাজ্যগুলিকে দিতে হয় না।
এইচ ডি দেবগৌড়ার আমলে ১৯৯৭ সালের বাজেটে সবথেকে ধনীদের উপর আয়করের হার ৪০% থেকে কমিয়ে ৩০%-এ কমিয়ে এনেছিলেন চিদম্বরম। তুলে দিয়েছিলেন কর্পোরেট সংস্থাগুলির সারর্চাজও। যা এখনও ‘স্বপ্নের বাজেট’ বলে পরিচিত। তার পরে চার-চারটি সরকার চলে গিয়েছে। চার জন অর্থমন্ত্রী বদলেছেন। কিন্তু করের হার বদলায়নি। এখনও আয়করের হার সেই ১০, ২০ ও ৩০ শতাংশই রয়ে গিয়েছে। এখন বছরে ১০ লক্ষ টাকার বেশি আয়সম্পন্ন সকলকেই ৩০% হারে আয়কর দিতে হয়। অর্থাৎ বছরে ১১ লক্ষ টাকা আয় হলে যে হারে কর দিতে হয়, ১১ কোটি টাকা আয় হলেও করের হার একই থাকে। বাজেটের আগে এই নিয়ে আলোচনার সময় চিদম্বরমের সামনেই এক অর্থনীতিবিদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে ফেলেছিলেন, “আমিও যে হারে কর দিই, মুকেশ অম্বানীও সেই হারে কর দেন। এটা কী ধরনের বিচার?” চিদম্বরম নিজেও অবশ্য সব থেকে ধনীদের উপরে বাড়তি কর বসানোর পক্ষে মত দিয়েছেন। গত মাসেই তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “সরকারের যখন আরও রাজস্ব আয় বাড়ানোর প্রয়োজন, তখন ধনীদের আর একটু উদার হওয়া উচিত— এমন একটা যুক্তি যে রয়েছে, সেটা আমাদের মানতেই হবে।” |
আয়করের হিসেব (২০১১-১২) |
|
বার্ষিক আয় |
দাতা |
কোটিতে |
শতাংশে কর |
০-৫ লক্ষ |
২.৮৮ কোটি |
১৫,০১০ |
১০.১ |
৫-১০ লক্ষ |
১৭ লক্ষ |
২১, ৯৭৬ |
১৪.৮ |
১০-২০ লক্ষ |
১৩ লক্ষ |
১৭,৮৫৮ |
১২.১ |
২০ লক্ষের বেশি |
৪ লক্ষ |
৯৩,২২৯ |
৬৩ |
মোট: ৩ কোটি ২৪ লক্ষ |
১,৪৮,০৭৩ |
|
রাজকোষের হাল এখন এতটাই করুণ যে মনমোহন সরকার আয় বাড়ানোর নিত্যনতুন পথ খুঁজছে মরিয়া হয়ে। আর সেই বরাবরের মতো বামেদের কাছ থেকে নয়, ধনীদের উপর করের হার বসানোর প্রস্তাবটা প্রথম এসেছে প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান সি রঙ্গরাজনের কাছ থেকে। তাঁর বক্তব্য ছিল, ধনীদের থেকে বাড়তি কর আদায়ের দু’টি পথ আছে। এক, সব থেকে ধনীদের জন্য নতুন করের হার তৈরি হোক। দুই, কর কাঠামো একই রেখে নির্দিষ্ট আয়ের উপরে সারচার্জ বসানো হোক। দ্বিতীয়টাই সহজ পন্থা।
ধনকুবেরদের উপর কর বসানোর হিড়িক এখন বিশ্ব জুড়েই। ব্রিটেন, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া এমনকী মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও সেই পথে হেঁটেছেন দেশীয় অর্থনীতির পতন রুখতে। কিন্তু ভারতেও কি সেই পথে হাঁটা সম্ভব? শিল্পমহল তথা অর্থনীতিবিদদের একাংশ এর বিরুদ্ধে। অর্থনীতিবিদ রাজীব কুমারের প্রশ্ন, এমনিতেই মোট কর আদায়ের ৬৩ শতাংশ আসে ২০ লক্ষ টাকার উপরে আয়সম্পন্ন ব্যক্তিদের পকেট থেকে। তাঁদের থেকে আরও কর আদায়ের সহজ রাস্তা নেওয়াটা কি যুক্তিসঙ্গত? প্রশ্নটা উড়িয়ে দিতে পারছেন না অর্থ মন্ত্রকের কর্তারাও। ২০১১-১২ সালের হিসেব বলছে, মোট ৩ কোটি ২৪ লক্ষ আয়কর দাতার মধ্যে ২০ লক্ষ টাকার উপরে আয়সম্পন্ন ব্যক্তির সংখ্যা মাত্র ৪ লক্ষের কিছু বেশি। তাঁদের পকেট থেকেই কর আদায়ের ৬৩ ভাগ আসে। অথচ ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়সম্পন্ন ব্যক্তির সংখ্যা ২ কোটি ৮৮ লক্ষ। মোট আয়করে তাঁদের অবদান ১০ শতাংশের সামান্য বেশি। আয়কর দাতার সংখ্যা ২০০২ সালে ছিল ৩ কোটি ১৬ লক্ষ জন। এক দশকে তা বেড়েছে মাত্র ৮ লক্ষ।
বণিকসভা ফিকি-র সভানেত্রী, ভারতে এইচএসবিসি-র কান্ট্রি হেড নয়না লাল কিদোয়াই, সিআইআই সভাপতি আদি গোদরেজ এক সুরে বলছেন, এতে লগ্নিকারীদের প্রতি নেতিবাচক বার্তা যাবে। তাঁরা তো ব্যবসা বাড়াতেই ভয় পাবেন। কিদোয়াই আবার ভয় পাচ্ছেন, যেখানে করের হার কম, লগ্নি চলে যাবে সেই দিকে। অর্থনীতিবিদরাও অনেকে মনে করছেন, এটা লগ্নিকারীদের প্রতি নেতিবাচক বার্তা শুধু নয়, এতে কর ফাঁকি আরও বাড়বে। তার থেকে আরও বেশি মানুষকে করের আওতায় নিয়ে আসা হোক। উইপ্রো-র আজিম প্রেমজি আবার ধনীদের উপর বাড়তি কর বসানোরই পক্ষে মত দিচ্ছেন।
অর্থ মন্ত্রক সূত্রের খবর, সব থেকে ধনীদের উপরে করের হার বাড়ানোর ঝুঁকি না নিয়ে তাই সারচার্জ বসানোর পথেই হাঁটতে চাইছেন চিদম্বরম। কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে এখন সারচার্জ গুণতে হলেও ব্যক্তিগত আয়করদাতাদের করের উপর সারচার্জ নেই। শুধু শিক্ষা সেস রয়েছে। সারচার্জ বসানো হলে মূল কর কাঠামোর পরিবর্তন হয় না। মোট করের উপর নির্দিষ্ট হারে বাড়তি কর দিতে হয়। সরকার দাবি করতে পারে, একটি নির্দিষ্ট কারণে সাময়িক ভাবে সারচার্জ বসানো হচ্ছে। পরিস্থিতি অনুযায়ী পরে তা তুলেও নেওয়া যায়। অর্থ মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, “সব থেকে সুবিধা হল, সারচার্জ বাবদ আয়ের পুরোটাই কেন্দ্রীয় সরকারের সিন্দুকে যায়। অন্যান্য করের মতো রাজ্যগুলির সঙ্গে তা ভাগ করে নিতে হয় না। রাজকোষ ঘাটতি সামলাতে এর থেকে অব্যর্থ দাওয়াই তাই আর কিছু হয় না।” |